Adeno death

‘ভেন্টিলেটর পেলে হয়তো বাচ্চাটা বেঁচে যেত’, সন্তান খুইয়ে মা-বাবা দুষছে সরকারকেই

রাজ্য

‘ঠিক সময়ে ভেন্টিলেটার পেলে হয়তো বেঁচেই যেত আমাদের বাচ্চাটা।’ একরত্তি বাচ্চাটাকে হারিয়ে মেঝেই লুটিয়ে পড়ে আর্তনাদ করে চলেছেন একটু বেশি বয়সের নাজমা বিবি। মেটিবাবুরুজ নাদিয়াল থেকে এসেছিলেন নাজমা বিবির পরিবার। রবিবার সকালে এই বি সি রায় হাসপাতালেই মারা গেছে তাঁদের পরিবারের সন্তান বছর দেড়েকের আতিফা খাতুন। জ্বর-শ্বাসকষ্টেৃর উপসর্গ নিয়ে গত সাতদিন ধরে এখানেই চিকিৎসা চলছিল আতিফার। 
এখন শুধু বি সি রায় নয়, শহর কলকাতার শিশু হাসপাতালগুলির সর্বত্রই একই ছবি। অ্যাডিনোর সংক্রমণ হোক বা না হোক, একই উপসর্গ নিয়ে পরের পর শিশুর মৃত্যু হয়ে চলেছে এভাবেই। রবিবার সকাল থেকে শুধু বি সি রায় শিশু হাসপাতালেই ৭টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই হাসপাতাল চত্বর ভরে উঠছে সন্তান হারানো মা-বাবার কান্নায়। তবু, সেই হাহাকার এখনও নবান্নে পৌঁছাচ্ছে কিনা, তার কোনও লক্ষণ নেই। কারণ এতদিনেও হাসপাতালে হয়নি আইসিইউ-তে বাড়তি বেড, কিংবা অতিরিক্ত ভেন্টিলেটারের বন্দোবস্ত।
রবিবার সকালেই এই হাসপাতাল চত্বরেই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন দেগঙ্গার বাসিন্দা অশোক ঘোষ। একরত্তি শিশুকে হারিয়ে তাঁর আর্তনাদ, ‘ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ওঁদের কোনও দোষ নেই। যত দোষ সরকারের, সরকার আইসিইউ’র কোনও ব্যবস্থাই করেনি।’
তখনই মুখ্যমন্ত্রী আবারও আর এক প্রস্থ আলোচনায় বসার তোড়জোড় করছেন স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকদের সঙ্গে। দিনের পর দিন আলোচনাই চলছে, কোনও সমাধান সূত্র নেই। বেড়েই চলেছে শিশুমৃত্যু। মৃত্যুর জন্য চিকিৎসা পরিকাঠামোর অব্যবস্থাকেই দায়ী করছেন পরিবারের লোকজন। সন্তান খোয়ানোর শোক ছাপিয়ে এক ভয়ানক আতঙ্ক চেপে বসছে সকলকে। ভেন্টিলেটর না পেয়ে নিজেদের ঘরের বাচ্চাকে হারানোর খেদ চেপে খানিক আগে নাজমা বিবি যেমন বললেন, ‘সরকার যদি আরও ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা না করে তাহলে আরও অসংখ্য মায়ের কোল খালি হয়ে যাবে এবার।’ 
প্রতিদিন সকাল থেকেই হাসপাতালে হাসপাতালে শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন মা-বাবার ভিড়। বি সি রায় হাসপাতাল থেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সহ কলকাতা ও জেলার প্রায় সমস্ত হাসপাতালেই একই ছবি। একরত্তি শিশুকে তোয়ালে কিংবা কাঁথায় জড়িয়ে নিয়ে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে ছুটোছুটি করেও তাঁরা জোগাড় করতে পারছেন না কোনো ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট বেড, বা নিদেনপক্ষে অক্সিজেনের নল, একটা ভেন্টিলেটর— এমন উদাহরণ প্রায় সর্বত্র। চোখের সামনে সন্তানকে তীব্র শ্বাসকষ্টে জেরবার হতে দেখছেন পরিবারের লোক। 
বি সি রায় হাসপাতালে এদিন এমনই পরিস্থিতিতে ছুটে গিয়ে বনগাঁর এক অসহায় মা— ‘ডাক্তারবাবু আমার ছেলেটাকে বাঁচান’ বলে এদিন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন চিকিৎসকের পায়ের কাছে। চিকিৎসকরা সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসা শুরু করেও দেন। বাচ্চাটিকে শিশুদের আইসিইউ রুমে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল সে সময়ে।
কিন্তু কোথায় কী? একটি ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের একটি বেডে একাধিক শিশু তখন অক্সিজেনের নল নাকে নিয়ে ভয়ঙ্কর অ্যাডিনো ভাইরাস আর নিউমোনিয়ার সঙ্গে লড়াই করছে। মেলেনি বেড, শিশু সন্তান নেই শুনে লুটিয়ে পড়েছিলেন সেই মা। তাঁর সেই চোখের জল মুছিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন আর এক সন্তান হারা পরিবারের লোক। 
দায় কার? চিকিৎসক, নার্স থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করলেও শুধুমাত্র পরিকাঠামোর অভাবকেই দায়ী করছে ভুক্তভুগী পরিবারগুলি। সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে অসংখ্য শিশু। জ্বর, শ্বাসকষ্টে গত ১২ দিনেই রাজ্যে ৪০টি’র বেশি শিশুমৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন বেসরকারি সূত্রের খবর অনুযায়ী এই সংখ্যা আরও বেশি।
দেগঙ্গার বেড়াচাপা অঞ্চলের গোবিন্দপুর থেকে আড়াই মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে বিসি রায় শিশু হাসপাতালে এসেছিলেন অশোক ঘোষের পরিবার। জ্বর ও শ্বাসকষ্টজনিত কারণে প্রথমে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিশুটিকে। পরে ছুটিও দেওয়া হয়। পরিস্থিতি খারাপ হতেই তাঁরা শিশুটিকে নিয়ে যান বিসি রায় হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে আইসিইউ না মেলায় ৫ দিন সাধারণ বেডেই রাখা হয় তাকে। শুক্রবার রাতে তাকে নিয়ে আইসিইউ-তে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, রবিবার সকালে মৃত্যু হয় শিশুটির। কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবা অশোক ঘোষ বলেছিলেন, ‘ডাক্তার নার্সরা চেষ্টা করছেন, সরকার আইসিইউ বাড়ায়নি। আরও অসংখ্য শিশু ধুঁকছে। সব দোষ সরকারের।’
এদিন এই হাসপাতালেই মারা গেছে বছর দেড়েকের আতিফা খাতুন। মেটিবাবুরুজ নাদিয়াল থেকে এসেছিলেন তাঁরা। গত ৭ দিন ধরে তার চিকিৎসা চলছিল। অন্যদিকে মিনাখা’র বাসিন্দা ৪ মাসের আরমান গাজির মৃত্যু হয়েছে এদিন সকালে। সেও গত ৬ দিন ধরে ভর্তি ছিল হাসপাতালে। এছাড়া বনগাঁ মালঞ্চের ৪ মাস বয়সের এক শিশুকে গত মঙ্গলবার ভর্তি করা হয়েছিল। জ্বর শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয়েছে তারও। একে অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাব, তার ওপর রবিবার বিসি রায় হাসপাতালে ফিভার ক্লিনিক বন্ধ থাকায় চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয় ভুক্তভুগী পরিবারগুলিকে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী এই ফিভার ক্লিনিক চালু করার কথা কলকাতা ও জেলার প্রতিটি হাসপাতালে। কিন্তু বাস্তবে তার বেশিরভাগেরই কোনও অস্তিত্ব নেই।        
      --------
photoছবি: রবিবার কলকাতার বি সি রায় হাসপাতালে সন্তান শোকে মুহ্যমান অসহায় মা-বাবার কান্না, হাহাকার। তাঁদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
 

Comments :0

Login to leave a comment