Panchayat election violence

প্রার্থীপদ প্রত্যাহারে তৃণমূলের তাণ্ডব, প্রতিরোধ গ্রামে গ্রামে

রাজ্য

গত দু’দিন ধরে একের পর এক উসকানিমূলক মন্তব্য সুর বেঁধে দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। 
যাবতীয় হামলা, হুমকির মুখোমুখি হয়েই রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে ৭৩ হাজারের কিছু বেশি আসনে প্রার্থী দিয়েছে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও আইএসএফ। বিরোধীদের এত সংখ্যক মনোনয়নেই ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেন— ‘সিপিএম বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করেছে!’
মুখ্যমন্ত্রীর ‘ইচ্ছা’ বুঝতে পেরেই এবার স্ত্রুটিনি পর্ব শুরু হতেই ফের বেপরোয়া তাণ্ডবের পথেই শাসক তৃণমূল। এখন মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বাড়ি বাড়ি হুমকি, মারধর, অপহরণ, মিথ্যা মামলা রুজু করে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তৃণমূল।
তবে এবার একতরফা তাণ্ডব, হামলা নয়। পুলিশ প্রশাসনকে নিয়ে মাঠে নামলেও প্রতিরোধের ধাক্কায় শাসকদলকে পিছুও হটতে হচ্ছে রাজ্যের একাধিক প্রান্তে।
যেমন, ময়ূরেশ্বরের সিপিআই(এম) প্রার্থীদের ওপর ব্যাপক চাপ, হুমকি, লাঠি হাতে মারধর শুরু হয়েছে শুক্রবার রাত থেকেই। তবুও শনিবার বিজেপি ও তৃণমূল ছেড়ে আসা বহু মানুষ এলেন সিপিআই(এম)র সঙ্গে, ময়ূরেশ্বর বাজারে দাঁড়িয়ে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে লালপতাকা। ইলামবাজারের গ্রামে গ্রামে লাগামছাড়া তাণ্ডব শুরু করেছে তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা। সিপিআই(এম) প্রার্থীদের মারধর করেছে। তবে গ্রামের মানুষ এককাট্টা হয়ে অনেক জায়গা পালটা তাড়া করেছে শাসকদলকে। বোলপুর মহকুমা জুড়েও তাণ্ডব শুরু করেছে তৃণমূল। বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করিয়েছে গায়ের জোরে। শুক্রবার থেকে সেই বেপরোয়া তাণ্ডবে নানুর, লাভপুর, বোলপুর ব্লকে সব ক’টি পঞ্চায়েত শাসকদল দখল করে নিয়েছে। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় থেজে বীরভূম জেলা জুড়ে যাবতীয় হামলার মোকাবিলা করেই ১৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতেই বড় অংশের আসনে প্রার্থী দিয়েছিল বিরোধীরা। কিন্তু মনোনয়ন পর্ব শেষ হতেই তৃণমূল স্বভাবসিদ্ধ পথই নিয়েছে। এতটাই সন্ত্রস্ত করা হয়েছে বিরোধী প্রার্থীদের যে শাসকদলের ঘেরাটোপে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে এসে কেউ কেউ বলছেন, ‘শরীর অসুস্থ’, কেউ বলছেন, ‘পারিবারিক সমস্যার কারণে’। আশঙ্কা, আগামী দু’দিন এই ভয়াবহতা আরও মারাত্মক রূপ নেবে। সিপিআই(এম) বীরভূম জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বকুল ঘোরুইয়ের স্পষ্ট অভিযোগ, পুলিশ নির্বিকার। গ্রামে গ্রামে আমাদের প্রার্থী ও তাঁদের পরিবারের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। 
অন্যদিকে পশ্চিম বর্ধমান জেলায় বারাবনী, সালানপুর, পাণ্ডবেশ্বর, জামুড়িয়া, দুর্গাপুর -ফরিদপুর, কাঁকসা ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে শাসকদলের দুষ্কৃতী বাহিনী সিপিআই(এম) প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের অপারেশনে নেমে পড়েছে। তবে স্রেফ হামলা চালিয়ে, মিথ্যা মামলা রুজু করেও সব জায়গায় প্রত্যাহার করাতে পারছে না। তাই এবার টাকার থলি নিয়ে নেমেছে বলে অভিযোগ। সিপিআই (এম) প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দর উঠেছে ৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত! পাণ্ডবেশ্বরের কেন্দ্রা গ্রাম পঞ্চায়েত, বৈদ্যনাথপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে সিপিআই (এম)’র গরিব প্রার্থীদের কাছে মনোনয়ন প্রত্যাহারের লক্ষ লক্ষ টাকার প্রস্তাব গেছে। একসঙ্গে তিনজনের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করাতে পারলে ৩০ লক্ষ টাকা!  প্রশ্ন উঠেছে, সামান্য গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরোধীদের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, তাহলে পঞ্চায়েত দখল করতে পারলেন কত টাকার মুনাফার কারবার?
মনোনয়ন জমা দেবার পর থেকেই গলসী ১ নম্বর ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে সিপিআই (এম) প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য হামলা হুমকি শুরু হয়ে গেছে। উচ্চগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের পুরন্দরগড়ে তৃণমূলের দপ্তরের পাশেই বাড়ি পঞ্চায়েতে সিপিআই(এম) প্রার্থীর প্রস্তাবক শেখ জাকিরের। জাকিরকে ঘর থেকে টেনে এনে মারধর করা হয়েছে। পারাজ, জাগুলিপাড়া, রামগোপালপুর জুড়ে মহিলা প্রার্থী সহ সিপিআই (এম) প্রার্থীদের বাড়িতে চড়াও হয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। এদিন পূর্ব বর্ধমানের গলসী-১ নম্বর ব্লকে স্ক্রুটিনি চলাকালীন বুদবুদ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পঞ্চায়েত সমিতিতে সিপিআই(এম) প্রার্থী মনসা তুরিকে মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দেয় তৃণমূলী বাহিনী। স্ক্রুটিনি শেষে পায়ে হেঁটে বুদবুদ বাজার অভিমুখে যাচ্ছিলেন লোয়া -রামগোপালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে লোয়া গ্রামের দক্ষিণ বাগদি পাড়ার বাসিন্দা সিপিআই(এম) প্রার্থী দেবীপ্রসাদ মণ্ডল। সেই সময় তৃণমূলী বাহিনী দেবীপ্রসাদকে ঘিরে ধরে মাটিতে ফেলে মারধর করে। তাঁর মোবাইল ছিনিয়ে নেয়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিভিন্ন জায়গায় সিপিআই(এম) প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য চাপ ও হুমকি দিচ্ছে তৃণমূলের বাহিনী। শুক্রবার রাতে ডায়মন্ডহারবার ২ নম্বর ব্লকের পাতড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মোল্লাপুকুর এলাকায় প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করতে সিপিআই(এম) প্রার্থীদের উপর আক্রমণ করে তৃণমূলের বাহিনী। ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই অঞ্চলে তৃণমূলের বাইক বাহিনী হাতে উইকেট নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয়। প্রতিবাদ করলে তাঁদের উপর আক্রমণ চালায় তৃণমূলের ওই বাহিনী। ৪ জন সিপিআই(এম) প্রার্থীসহ আরও বেশ কয়েকজন স্থানীয় পার্টি নেতৃত্ব জখম হয়েছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসা করা হয়েছে। শনিবার সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ীসহ স্থানীয় পার্টি নেতৃত্ব পাতড়া অঞ্চলে গেলে তৃণমূলের বাহিনী এলাকায় সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত করে। শমীক লাহিড়ী এদিন সাংবাদিকদের জানান, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বারুইপুর, বজবজ ২, বিষ্ণুপুর ২, বিষ্ণুপুর ১, ঠাকুরপুকুর মহেশতলা, ডায়মন্ডহারবার ২ ব্লকের বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনী সিপিআই(এম) প্রার্থীদের প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করতে চাপ দিচ্ছে ও হুমকি দিচ্ছে। 
এদিন ক্যানিংয়ে মনোনয়ন ঘিরে পরিস্থিতি দেখতে আসেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। ক্যানিংয়ের হাসপাতাল মোড়ে তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ক্যানিং-১ ব্লকে বিরোধী সিপিআই(এম), আইএসএফ প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে দেয়নি তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনী। সিপিআই(এম) দপ্তরে আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এমনকি ক্যানিং ১ ব্লকের তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি শৈবাল লাহিড়ীকেও মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি। এদিন রাজ্যপাল ক্যানিংয়ের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। 
একইভাবে পশ্চিম মেদিনীপুরেও সিপিআই(এম) ও আইএসএফ-এর প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করানোর জন্য তৃণমূলী সশস্ত্র বাহিনীর তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। তবে একাধিক জায়গায় জনরোষের চেহারায় প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটেছে। জেলার চন্দ্রকোনা থানার কৃষ্টপুর, ভগবন্তপুর, চৈতন্যপুর, নারায়ণগড়ের গ্রামরাজ, গ্যাংকটিয়া, কুশবসান, সবং এর দশগ্রাম, আদাসিমলা, নেধুয়া, পিংলার জামনা, কুসুমদা, ঘাটালের দেওয়ানচক সহ একাধিক স্থানে এমন প্রতিরোধে শামিল হয়েছেন সাধারণ মানুষ।
রাতের অন্ধকারে গ্রামে বাইক বাহিনী তাণ্ডব চালাতে এলে গ্রামের মানুষ হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়েই জোটবদ্ধভাবে পালটা জবাব দিয়েছেন। জনরোষের মুখে বাইক বাহিনী এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। চন্দ্রকোনার কৃষ্টপুরে গ্রামের মানুষ প্রতিবাদে পুলিশ প্রসাশনকে ঘিরেও বিক্ষোভ করেন। 
সবংয়ের দশগ্রামে মহিলা প্রার্থী চন্দনা বেরা ও তাঁর স্বামী হরিপদ বেরাকে অপহরণ করতে গিয়ে তৃণমূলের সশস্ত্র বাইক বাহিনী তাঁদের না পেয়ে ঘর ভাঙচুর করে। হরিপদ বেরার ভাইকে অপহরণ করে তেমাথানিতে মন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার ডেরায় নিয়ে গিয়ে আটক করে রাখা হয়েছে। ঐ দিন রাতেই নারায়ণগড়ের গ্রামরাজ বুথের সিপিআই(এম) প্রার্থী তরুণ পালকে রাস্তায় ঘিরে মারধর সহ তাঁর মোবাইল সাইকেল ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল। তারপর মনোনয়ন প্রত্যাহারের ফর্মে সই করতে চাপ দেওয়া হয়। গ্রামের মানুষ খবর পেয়ে ছুটে এলে তৃণমূল পালিয়ে যায়।
 

Comments :0

Login to leave a comment