STROY / MUKTADHARA — MAYURI MITRA | TAI JEGE RAI — 15 APRIL 2024

গল্প — মুক্তধারা | তাই তো জেগে রই | ময়ূরী মিত্র — ১৫ এপ্রিল ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

STROY  MUKTADHARA  MAYURI MITRA  TAI JEGE RAI  15 APRIL 2024

গল্প  মুক্তধারা

তাই তো জেগে রই

ময়ূরী মিত্র

সেবার বেশ শীত পড়েছে ৷ শীতের সঙ্গে মেঘের একটানা দ্রবণে  চারদিকে কেমন এক শীতল - পিচ্ছিল ভাব ৷ রোদ উঠছিল না কদিন ধরেই -সঙ্গে পাখির পালকের মতো পলকা একটা হাওয়া ৷  শীতের দিনে মেঘের মিশেলে  এমন   চপল   হাওয়া দিলে  দেশ গাঁয়ের  লোক বলত ---ওহ আজ  হাওয়া কী " চালছে " !  মানে হল গিয়ে আপনার -- হাওয়া চলছে ৷ এমন হাওয়া চলল , মানে গাঁ ঘরের ফচকে খুকিরা তিড়বিড় করে ছুটবে এর ওর বাড়ি -- তাদের ফালতু  কথার ফুলুরি নিয়ে ৷ গৃহস্থের আবশ্যক কম্ম যেটুকু না করলে নয় সেটুকুই করবে সেসব দিনে  ৷ 
             আমি যেদিনের কথা বলছি -  সেদিনও হাওয়া ছুটন্ত তীর হয়ে আমার ও আমার  বাচ্চাদের চামড়া ফাটাচ্ছিল ৷ তার মধ্যে একটি ছিল অটিস্টিক ৷তাকে  দেখলাম --জগত সংসার ভুলে একবার হাত দুলিয়ে হাওয়া বোঝার চেষ্টা করছে --সঙ্গে সঙ্গেই আবার নিজের কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় হাত বুলিয়ে নিচ্ছে ৷ বাচ্চাটি একসময়  ভাবুক হয়ে গেল --তখন তার চোখ ভূমির ওপর বয়ে যাওয়া হাওয়া ছেড়ে আকাশের মেঘে ঘুরতে লাগল ৷ বুঝলাম -সাধারণভাবে  একমনে থাকা বাচ্চাটা মেঘ ,হাওয়া ও নিজের ছোট্ট শরীরটার মধ্যে সংযোগ বোঝার  চেষ্টা করছে ৷ একটা প্রাণের চেষ্টা ৷  একসময় বুঝতে না পেরে সে কেঁদে ফেলল ফুঁপিয়ে ৷ তখন আকাশে একটুকরো রোদ উঠছে ৷ ঠাণ্ডা আরো বাড়ছে ৷ বুঝলাম --কথা দিয়ে এ বাচ্চাকে বোঝান যাবে না ৷ পাঠকদের বলে রাখি --Autistic বাচ্চা অন্যের ভাবনা নিজের ঘাড়ে চাপাতে একেবারেই চায় না ৷ চাপাতে গেলে বিরক্ত হয় ৷ এরা নিজে ভাবতে চায় ৷ ভাবনায় ডুবে থাকতেও পারে ৷ 
                    একটিও কথা না বলে তাকে আলতো করে ঠেলে দিলাম  উঠোনের এমন একটি জায়গায় যেখানে শীতল হাওয়ার সঙ্গে সদ্য ওঠা রোদ এসে পড়েছে ৷ 
----এই  জায়গায় দাঁড়িয়ে তোর যা ভালো লাগে খেল ৷ তবে খেলতে হবে এই জায়গায় দাঁড়িয়েই ৷ --যতদূর মনে পড়ছে এমন ধরণের কিছু কথা বলেছিলাম তাকে ৷ 
                  আমার কথা শুনে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে রইল সে ৷ মনে হল --বনের মাঝে কোনো ঋষির ছেলে আকাশে পুষ্প ছুঁড়ছে তার চোখ দিয়ে ৷ মেঘ থেকে রোদ -- প্রকৃতির এই অপরূপ পরিক্রমা এমনই গভীর ও উজ্জ্বল করে  তুলছিল তাকে  ৷ তার চোখে অক্ষর লেখা হচ্ছিল ৷  তবে মেঘ না রোদ --কে সে অক্ষর তৈরী করছিল তা জানি না ৷
              হঠাৎ বাচ্চাটা পাখির মতো দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে দৌড়োতে শুরু করল  - ৷ এত জোর ছিল সে দৌড়ে -  মনে হল স্কুলের গেটে  দড়াম শব্দ অন্যদিনের চেয়ে অনেকগুণ বেশি হয়েছিল ৷ প্রথমবার বাঁকা হাতে গেট খুলতে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বার দড়াম করল ৷ এসব  তাকে নিয়ে আমার  ভালোবাসায় মেতে থাকার ভুল কিনা তা অবশ্য বলতে পারব না ৷

অনেকটা তফাতে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছি --আকাশের  পাখি  দেশান্তরে যাওয়ার সময় যেমন  পথ পরিবর্তন করে নিজের ডানা বাঁকিয়ে - ঠিক সেভাবে  নিজের সামান্য  বেঢপ শরীরটাকে কাত করে সামনে পিছে ডাইনা বাঁয়ে  নাচিয়ে যাচ্ছে সে ৷ 
           
-----  এই শোন না ! তাকা আমার দিকে ? এমন করে নাচ্ছিস ক্যানো ? নাচবি যদি -ক্যাসেট বাজাচ্ছি --গানের সঙ্গে নাচ ৷
--------নাচিনি তো ৷ আমি Bird হয়েছি ৷
      --- সে আবার কী রে? তুই তো তোর মায়ের বাচ্চা --তুই আমার বাচ্চা ৷ তুই পাখি হবি কী করে ?
    ----     কী হাওয়া মিস কী হাওয়া ৷ ও মিস
হাওয়া আমায় পাখি করে দিল  ৷

 ---- দেখি - হাওয়া তখন তেমন না চললেও সে বাচ্চা নিজের পাতলা শরীরটাকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে আরো আরো হাওয়া কল্পনা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ৷
              আমি চুপ ৷ ছোট মানুষের সৃষ্টিকর্মকে বোধহয় সবচেয়ে মর্যাদা দিতে হয় ৷ কারণ তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য বিধেয় সে নিজেই জানে না ৷ তখন তার মন  এতটাই স্ফূর্ত হয় ৷
                 যথারীতি আমাকে চুপ দেখে তার কথা বাড়ল - -- 
          ---  দেখো না বাতাস কেমন নখ দিয়ে আমার লোমগুলো খুঁচিয়ে দিচ্ছে ! এই দেখো -- ওহ --এই দেখো আমার লোমগুলোও পাখি হয়ে গেছে ৷ লোমও কি আকাশে উড়ে যাবে মিস ? 
            বোকা মুখ করে বললাম --আচ্ছা তাই ? তো হাওয়াটা কেমন বল দেখি ?
            ---- কেমন আবার ! K F C এর প্লাস্টিক প্যাকেটের মতো ৷ একদম  প্লাস্টিক হাওয়া ৷   
   
--- ধুর ! প্লাস্টিক  আবার হাওয়া  হয় নাকি ? আর K F C এর মুরগির ঠ্যাং কি এ হাওয়ায় ঘুরছে ? কই -আমি দেখতে পাচ্ছি না তো ৷ শিগগির দেখা আমায় ৷
---- আরে হয় ---হয় গো ৷ এই দেখো না --পিড়িং পিড়িং লাফ দিচ্ছি ৷

--- কী আজে বাজে বলছিস ? প্লাস্টিক হাওয়া হঠাৎ  পিড়িং পিড়িং হাওয়া  হয়ে গেল  ? ওমা ! তোর হাওয়া বুঝি মুরগি থেকে পিড়িং শাক হয়ে যায় ?

--- ও মিস৷ প্লিজ প্লিজ ও মিস ৷ একটু শোনো --৷ মা যখন আমার গায়ে সেন্ট দেয় তখন সেন্টের শিশির মুখের স্প্রে স্প্রে হাওয়া ৷ এবার -- এবার ঠিক বলেছি মিস ? বল না ?

দুপুর এল ৷ তবু তার হাওয়ার গল্প থামল না ৷  

হাওয়ার বর্ণনায় তার সেই "রকম " আর "মতো" গুলো পাকসাট দিতে লাগল স্কুলের গলিতে ৷
শিক্ষক বুঝতে পারছে না --হাওয়া এখনো বইছে ৷   
ছাত্র  তখনো  উড়ছে ৷

অনুভূত না হলেও বাতাস  থেকেই যায় --জীবের শ্বাস অটুট রাখার জন্য ৷

Comments :0

Login to leave a comment