Anubrata mandal Saktigarh restaurant

পুলিশের ঘেরাটোপেই বিচারাধীন অনুব্রতের শলা দোকানে বসে

রাজ্য

Anubrata mandal Saktigarh restaurant

 সকাল পৌনে সাতটায় গোরু পাচার কাণ্ডে অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলকে নিয়ে রওনা দিয়েছিল আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেটের কনভয়। সেই কনভয়েই বেমালুম ছিল তৃণমূলের শীর্ষ মহলের ‘বার্তা’ পৌছে দেওয়ার জন্য দলীয় বাহিনীও!
বেনজির ঘটনা। গোরু পাচার কাণ্ডে চার্জশিটে অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত, জেলবন্দিকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার প্রাক-মুহুর্তেও শীর্ষ মহলের ‘বার্তা’ নিয়ে আসা দলীয় বাহিনীর সঙ্গে সলা-পরামর্শের সুযোগ করে দিল পুলিশ। অনুব্রত সহ পুলিশের খাবারের বিলও মেটালো তৃণমূল!


মঙ্গলবার সকাল পৌনে সাতটায় রওনা দিয়ে ৮টা ৪৫মিনিট নাগাদ শক্তিগড়ে পৌঁছেছিল অনুব্রত মণ্ডলকে পুলিশের কনভয়। শক্তিগড়ের ‘ল্যাংচা কুঠি’তে এসে দাঁড়ায় অনুব্রতকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমেই অনুব্রত মণ্ডল দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়েন। পুলিশ কর্মীরাও গাড়ি থেকে নেমে পড়েন প্রাতঃরাশ সারতে। ধীরে সুস্থে নেমে অনুব্রত মণ্ডলও দোকানের কোনার দিকে একটি টেবিল বসে পড়েন। দৃশ্যতই বোঝা যাচ্ছিল যেন আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল কোন টেবিলে বসবেন।


নাটকের শুরু এরপর থেকেই। বিচারাধীন বন্দির ঐ টেবিলেই এর পরে এসে বসে পড়েন তিনজন। দু’জন পুলিশের কেউ নন। একজন আসানসোল জেল কর্তৃপক্ষের এক ব্যক্তি। এদের মাধ্যমেই অনুব্রত মণ্ডল ডালপুরি, ল্যাংচা, রাজভোগের অর্ডারও দিলেন। সব পুলিশকর্মীদের জলখাবারের মেনুও নিজেই ঠিক করে দিলেন। এরপরেই দেখা গেল দু’জনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে টিফিন করার নামে রীতিমত সলা-পরামর্শ চললো! গোটা পুলিশ বাহিনী তাঁদের কথা বলার সুযোগ করে দিল শুধু নয়, ক্যামেরাতে যাতে তাঁদের ধরা না যায় তার জন্য আড়াল করে রাখার চেষ্টা চালালো।
  আসানসোল জেল থেকে যখন অনুব্রতকে নিয়ে কনভয় রওনা দেয় সেখানেই ছিল আরও একটি গাড়ি। জানা গেছে গোরু পাচার কাণ্ডেই একাধিকবার সিবিআই-ইডি’র জেরার মুখে পড়া অনুব্রত ঘনিষ্ঠ শিক্ষা ব্যবসায়ী, স্বাস্থ্য ব্যবসায়ী মলয় পিটের গাড়ি সেটি। 


  গ্রেপ্তার হওয়ার আগেও নীল বাতির যে গাড়ি চড়তো অনুব্রত মণ্ডল সেটাও এই মলয় পিটের সংস্থা ‘স্বাধীন ট্রাস্ট’র নামে। মলয় পিট আগেই নিজে মুখে স্বীকার করেছেন, অনুব্রত মণ্ডলের সহযোগিতায় সহজেই অনেক সমস্যার সুরাহা হয়েছে কলেজ করতে গিয়ে। বোলপুরের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও তাঁর রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পলিটেকনিক, ডিএড, বিএড, নার্সিং ও আইটিআই কলেজ। এমনকি ত্রিপুরা ও আন্দামানেও তাঁর কলেজ রয়েছে। অনুব্রত মণ্ডলের যে গাড়িগুলি উদ্ধার হয়েছিল তা এই মলয় পিটের স্বাধীন ও সুতীর্থ নাম ট্রাস্টের গাড়ি! অনুব্রত মণ্ডলের স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য নগদ ৬৬লক্ষ টাকাও দিয়েছিল এই বক্তি।  
এহেন মলয় পিটের গাড়ি সকাল পৌনে নটা নাগাদ পৌছে গেল শক্তিগড়ের ‘ল্যাংচা কুঠি’তে। গাড়ির ভিতরে ছিল দুই ব্যক্তি। 


  কারা তাঁরা? একজনের নাম কৃপাময় ঘোষ। দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম তুফান মিদ্দা। তাঁদের পরিচয় কী? প্রথমজন বোলপুরে তৃণমূলের অফিসে কাজ করেন। মূলত অনুব্রত সহ নেতাদের ফাইফরমায়েশ খাটেন। অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ। দ্বিতীয় জন হলেন অনুব্রত কন্যা সুকন্যা ভট্টাচার্যের গাড়ির চালক। সুকন্যা ভট্টাচার্য তদন্তের নজরদারিতেই আছেন। একাধিকবার জেরার মুখে পড়েছেন। দিল্লিতেও ইডি দপ্তরে জেরা করা হয়েছে তাঁকে। সুকন্যা ভট্টাচার্যের দুটি সংস্থার মাধ্যমে গোরু পাচারের টাকা লেনদেন হয়েছে। এই তুফান মিদ্দাকেও গোরু পাচার কাণ্ডেই জেরা করা হয়েছে।


 তাহলে কী দাঁড়ালো? গোরু পাচার কাণ্ডেই জেরার মুখে পড়া, তদন্তের নজরদারিতে থাকা ব্যবসায়ী গাড়িতে চেপে গোরু পাচারেই জেরার মুখে পড়া মেয়ের গাড়ির চালক ও বোলপুরের তৃণমূল অফিসের কর্মী যেন লাস্ট মিনিট সাজেশনের জন্য বেমালুম দেখা করতে চলে এলেন বন্দি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে।
  পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যেই পুলিশেরই আয়োজনে এক টেবিলে বসে তাঁরা টিফিন করলেন, দীর্ঘ গোপন আলোচনা সারলেন তারপর অনুব্রত সহ বাকি পুলিশ কর্মীদেরও খাবারের জলখাবারের বিল ৯৯৫ টাকা মিটিয়ে দিল বোলপুরে তৃণমূল অফিসের কর্মচারী কৃপাময় ঘোষ! কীভাবে বিচারাধীন বন্দির সঙ্গে বাইরে লোক এক টেবিলে বসে খেতে খেতে আলোচনা সারলো, তৃতীয় ব্যক্তি কীভাবে বন্দি অনুব্রত সহ পুলিশের খাবারের বিল মেটালো? স্বাভাবিকভাবেই উঠছে প্রশ্ন। 


 গোরু পাচারে অভিযুক্ত দলীয় নেতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। ইঙ্গিত পেয়েছিল শাসক দল,পুলিশ প্রশাসনও। গত চার মাস ধরে অনুব্রত মণ্ডলের দিল্লি যাত্রা ঠেকানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরেও পুলিশ প্রশাসন যেভাবে শেষ মুহুর্তেও বিচারাধীন বন্দি অনুব্রত মণ্ডলকে ‘সলা-পরামর্শের’ সুযোগ করে দিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। আদালতেও পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে চলেছে।
 গোটা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সুজন চক্রবর্তী বলেন, একজন গোরু পাচারকারী, বন্দিকে পুলিশের হাতে থাকা অবস্থায় পুলিশমন্ত্রীর হয়ে বার্তা দিতেই পাঠানো হয়েছিল দু’জনকে। বোঝাই যাচ্ছে এই ব্যক্তির জেরা কী দুশ্চিন্তায় ফেলেছে পুলিশমন্ত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার চেহারাও বোঝা যাচ্ছে এই ঘটনায়।

Comments :0

Login to leave a comment