একাধিক অসঙ্গতি। একাধিক প্রশ্ন। আরজি কর হাসপাতালের ঘটনায় ক্রমেই রহস্য বাড়ছে। পুলিশ প্রশাসন থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি কোনও কিছু আড়াল করতে চাইছে, প্রভাবশালীর ‘ব্যাক আপ’ আছে এমন কাউকে বা একাধিক জনকে আড়াল করতেই তদন্তকে নির্দিষ্ট একটি দিকেই টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? উঠছে এই প্রশ্ন।
নৃশংস বর্বরতায় ধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পুলিশের দাবি অনুযায়ী তা ৩০-৩৫ মিনিট সময়ের মধ্যেই করা হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে ৩১ বছর বয়সি একজন তরুণী চিকিৎসকের ওপর ওই পাশবিক যৌন অত্যাচার করে খুন করা আদৌ সম্ভব একজনের? স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তাহলে বাকি অভিযুক্তরা কোথায়? ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, যে পরিমাণ বীর্য মিলেছে তা একজনের নাকি একাধিক জনের, তার উল্লেখ নেই রিপোর্টে। তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ধৃত সিভিক সঞ্জয় রায়ের বীর্যের নমুনা ফরেনসিকে পাঠানো হলেও সেই রিপোর্ট আসেনি। ফলে পুলিশের হাতে ধৃত ওই সিভিকের বীর্য নমুনার সঙ্গে নিহত চিকিৎসকের শরীর থেকে মেলা বীর্যের মিল আছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। পুলিশে একটি সূত্রের দাবি, দু’জনের বীর্য নমুনার হদিশ মিলেছে। যদি তাই হয় তাহলে দ্বিতীয় ব্যক্তি কে? ৭২ঘণ্টা পরেও সেই তদন্তের অগ্রগতি কোথায়? দু’দিন ধরে হেপাজতে নিয়ে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ সেই দাপুটে সিভিককে জেরা করে বাকি অভিযুক্তদের হদিশ মিলল না? দলবদ্ধ ধর্ষণকে আড়ালের চেষ্টা? কলকাতা পুলিশের দক্ষতার সঙ্গেই তা কি মাননসই? তাহলে কি এমন কোনও অভিযুক্তদের নাম রয়েছে যাদের আড়াল করতে চাইছে প্রশাসন, বিশেষত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ?
এর আগে পুলিশের একটি সূত্রে জানানো হয়েছিল প্রথমে ধাক্কাধাক্কির পরে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের চার তলায় সেমিনার হলে ওই তরুণী চিকিৎসককে শ্বাসরোধ করে খুন, তার পরে নাকি মৃতদেহকে ধর্ষণ করা হয়। যদিও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে যাবতীয় আঘাত, এমনকি যৌনাঙ্গেও যাবতীয় আঘাত সবই খুনের আগে। অর্থাৎ ধর্ষণের পরেই খুন করা হয়েছে। যে পরিমাণ বীর্যরস মিলেছিল তা আদৌ এক ব্যক্তির? উত্তর মিলছে না, অন্তত পুলিশের তরফ থেকে। তাহলে ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই আগেই কি করে বলা হলো মৃতদেহকে ধর্ষণ?
এরই মধ্যে এবার সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে একটি অডিও কথোপকথন। আর জি কর হাসপাতালেরই এক ইন্টার্নের সঙ্গে অন্য মেডিক্যাল কলেজের পিজিটি চিকিৎসকের সেই কথোপকথনে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে (গণশক্তি অডিও কথোপকথনের সত্যতা পরীক্ষা করেনি)। তাতে আর জি কর হাসপাতলে ইন্টার্ন খেদের সঙ্গেই জানাচ্ছেন যে আর জি কর হাসপাতালে ভিতরে গোটা আন্দোলনটাই মেকি। অধ্যক্ষ ও তাঁর শাগরেদরাই এই আন্দোলন চালাচ্ছে যাতে কলেজের প্রশাসনিক প্রধানের পদত্যাগের দাবি সামনে না আসে। শুধু তাই নয় এরপর সেই ইন্টার্ন জানায় আমাদেরই এক ইন্টার্ন জড়িত। আমারই ব্যাচ-মেট এমন করতে পারে। তাঁকে নিরাপত্তা দিতেই এতগুলো গেম খেলা হচ্ছে। গোটা আন্দোলনটাই আমাদের কলেজ কর্তৃপক্ষ চালাচ্ছে। সবার কাছে আমার আবেদন, আমাদের উপর নির্ভর করবেন না। একজন মহিলা, একজন মা, একজন বোনের উপর এমন হয়েছে। সাধারণ মানুষ, অন্যান্য কলেজগুলি যেন আমাদের পাশে থাকে। আর জি কর থেকে কিছু আশা করো না। যেখানে অভিযুক্ত লুকিয়ে রয়েছে, সেখানে আমাদের থেকে কিছু আশা করো না। তোমরা নিজেদের মতো আন্দোলন করে যাও...।’
এই অডিও কথোপকথন সামনে আসতেই প্রবল চাঞ্চল্য তৈরি হয়। হাসপাতালেরই একটি সূত্রে সামনে আসে এক ইন্টার্নের নাম। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত। বাকুঁড়ায় তাঁর বাড়ি। অধ্যক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে। কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়ায় একাধিক দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গোটা ঘটনায় সে যুক্ত ছিল এমনই অভিযোগ সামনে আসতে শুরু করে। যদিও এরপরেই রাতে সেই তৃণমূল সমর্থক ইন্টার্নই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানায় তাঁর নামে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
রাতে আর জি কর হাসপাতালে আসেন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল। হাসপাতালের নিরাপত্তার বিষয় খুঁটিয়ে দেখার পরে পুলিশ কমিশনার প্রায় ওই ফেসবুক পোস্টের সুরেই বলেন- কথায়, ‘একাধিক লোক যুক্ত বলছে কেউ, বলা হচ্ছে কাউকে আড়ালের চেষ্টা চলছে। তিনজনের বীর্য পাওয়া গিয়েছে বলে নানা গল্প ঘুরছে। এগুলো একেবারেই গুজব। যদি কারও কোনও প্রশ্ন থাকে, আমাদের কাছে যোগাযোগ করতে পারেন। আমরা একটা হেল্পলাইন নম্বর চালু করে দেব, সেখানেও ফোন করে কারও কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন। পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ জানানো যাবে।’ তবে কি নির্দিষ্ট নাম আসার পরেই গুজবের তত্ত্ব সামনে আনতে হচ্ছে পুলিশকে? তাহলে কি তদন্ত বিশ বাঁও জলে? পুলিশকে তথ্য জানানোর আবেদন জানানো হচ্ছে তিনদিন পরে। তাহলে নতুন করে অগ্রগতি কোথায় তদন্তে? সঙ্গত কারণের কলকাতা শহরের নামজাদা সরকারি হাসপাতালের ভিতরেই কর্তব্যরত তরুণী চিকিৎসকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার মত সংবেদনশীল ঘটনাতেও কলকাতা পুলিশ তদন্তে কী কোনও বাধা পাচ্ছে?
এদিকে কলকাতা পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, আরজি কর কাণ্ডে আরও এক সিভিকের নাম সামনে এসেছে। সেদিন ঘটনার সময় ইমার্জেন্সির চার তলায় দু’জন সিভিক ছিল। ধৃত সঞ্জয় রায় ছাড়াও নাকি আরেকজন সিভিক ছিলেন। তাঁর মা আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসাধীন আছে। সেদিন রাতে তাকেও সঙ্গে নিয়েছিল সঞ্জয় রায়। ওই সিভিকও সশস্ত্র পুলিশের চতুর্থ ব্যাটেলিয়নের ব্যারাকে থাকতো। তাকে জেরা করা হয়েছে বলেও জানা গেছে পুলিশের একটি সূত্রে। গোটা ঘটনাক্রমে হাসপাতালের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয় এমন ব্যক্তিদের যোগেই কি তদন্তে পুলিশ বাড়তি জোর দিচ্ছে, উঠছে সেই প্রশ্নও।
RG KAR INVESTIGATION
সন্দেহ জোরালো করছে সরকারই
×
Comments :0