মহম্মদ সেলিম
সেদিন তখন আমি রাস্তায়, সম্ভবত কোনও মিটিং সেরে বাড়ির দিকে ফিরছি। আমায় যোগাযোগ করে বললেন, ‘‘কোথায় তুমি?’’ বললাম, বাড়ি ফিরছি। বললেন, ‘‘জানো তো বইমেলায় আগুন লেগেছে? তুমি এখনই সেখানে যাও। প্রশাসন থেকে যা করতে হয় আমি করছি। তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে গোটাটা দেখো। আগুন শেষ করতে পারবে না বইমেলাকে। আমরা আবার গড়ে তুলবো।’’কথা রেখেছিলেনও। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল কলকাতা বইমেলা। গিল্ডের পাশে দাঁড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়ে সরকার সাহায্য করেছিল।
আবার ১৯৯৬ সালে অমরনাথে সেই বিপর্যয়ে, প্রবল তুষারপাত ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সেই সময়ে আমি দিল্লিতে ছিলাম। বুদ্ধদা ফোন করে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি দিল্লিতে আছি তো! জানার পরেই বললেন, ‘‘তুমি এখনই ওখানে যাও। যা যা সাহায্য লাগবে, আমি এখান থেকে ব্যবস্থা করছি।’’নির্দেশ পেয়েই আমি ছুটেছিলাম সেখানে। এই কথাগুলো বলছি এই কারণে যে, বুদ্ধদা আমার কাছে যেমন আমার পার্টির নেতা, তেমনই ব্যক্তিগত জীবনেও দাদার মতোই ছিলেন। ওঁর মৃত্যুতে ব্যক্তিগত শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ওঁর প্রতি একটা শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল আমার। রাজনীতি, সাহিত্য নানা বিষয়ে পাণ্ডিত্য ছিল। তবে যাবতীয় ভাবনার আধার ছিল মার্কসবাদী-লেনিনবাদী চিন্তা।
শত আক্রমণ, সমালোচনার মুখে দাঁড়িয়েও মার্কসবাদী দর্শনের মৌলিক ভাবনার প্রতি দৃঢ়, ঋজু অবস্থান থেকেই তার সৃজনশীল প্রয়োগের প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কূপমণ্ডূকতার বাইরে বেরনোর ভাবনাকেই সবসময়ে রসদ জোগাতেন। কেবলই বামফ্রন্ট সরকারর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নন, এরাজ্যের বুকে বাম যুব আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্ব, যুব আন্দোলনের নতুন ধারা, কর্মসংস্থান, সবার জন্য কাজের দাবিকে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন। ডিওয়াইএফ’র প্রথম রাজ্য সম্পাদক ছিলেন। যুব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জেলায় জেলায় তাঁর কাজের ব্যাপ্তি দেখা যায়। সমাজের প্রান্তিক অংশের মধ্যেও সেই সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬০’র দশকের শেষভাগ থেকে ১৯৭০’র প্রথমদিকের সেই সময়কালে। তাঁর বিশ্বাস, মতাদর্শের প্রতি ছিলেন অবিচল, ঋজু। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যেকার ঘটনাপ্রবাহের প্রতি ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। লাতিন আমেরিকার গতিস্রোতকে খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। ২০০০ সালে তিরুবনন্তপুরমে আমাদের পার্টি কর্মসূচিকে সময়োপযোগী করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। মতাদর্শের প্রতি দৃঢ় অবস্থান নিয়েই চিন্তা-ভাবনার পরিসরকে সবসময়ে বিস্তৃত করার কথা বলতেন। দেশ-দুনিয়ার ঘটনাবলিকে মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষার দৃষ্টিতেই দেখতেন। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রবল কঠোর অবস্থান নিতেন।
বহুধা বিস্তৃত ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। সেই চিন্তার ধারা আমরা অনেকেই দেখেছিলাম। ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন আড়ম্বরহীন। অপ্রয়োজনীয় বৈভবের থেকে সবসময়ে দূরত্ব তৈরি করতেন। তাঁর ছিল সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ। কবিতা লিখতেন, পড়তেন। ছিলেন অনুবাদক, নাট্য ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ছিল তাঁর অনুরাগ, নিজে আবৃত্তিও করতেন। সবথেকে বড় কথা ছিলেন এক জন আপাদমস্তক ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব। একইসঙ্গে বিশ্বাস করতেন ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে’। বলতেন, ‘শতফুল বিকশিত হোক’। সাংস্কৃতিক জগতে বহুত্ববাদে বিশ্বাস করতেন, শেষ দিন পর্যন্ত সেই আস্থায় অটল ছিলেন। ফতোয়া নয়, বহুত্ববাদ। সমাজতান্ত্রিক চেতনার নিরিখেই তিনি তা দেখতেন। বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনাতেই শুধু কলকাতায় নন্দন, মধুসূধন মঞ্চ বা আকাদেমি নয়, জেলায় জেলায় রবীন্দ্রভবন নির্মাণ ও সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্রকে প্রসারিত করার ভাবনাকে বাস্তবায়িত করেছিলেন।
তরুণ প্রজন্মকে সবসময়ে উৎসাহিত করে গিয়েছেন কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আধুনিক ভাবনাকে খোলা মনেই দেখতে ভালোবাসতেন। তাই আজও তরুণ প্রজন্ম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করছে। কৃষির সাফল্যকে সংহত করে, আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে উন্নত সেচ ব্যবস্থা, শস্যের বৈচিত্রকরণ, উৎপাদনশীলতাকে বাড়িয়েই গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিকে সুসংহত করে বেকার যুবক-যুবতীদের কাজের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে চেহারা দিয়েছিলেন উৎপাদন শিল্প, পরিষেবা ক্ষেত্রের বিস্তৃতি ঘটিয়ে। আধুনিক মনন নিয়ে যুবকদের, তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়েছিলেন। ভারী শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের বিকাশেও বামফ্রন্ট সরকার একগুচ্ছ কর্মসূচি নিয়েছিল। তাতে সাফল্যও এসেছিল।
শিল্পের বিকাশ ঘটাতে, শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্নকে এরাজ্যের বুকে বাস্তবায়িত করতে বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়ার শক্তির তৎপরতা, সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার মিশেল শুধু তাঁর স্বপ্নকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তা নয়। আসলে ভবিষ্যৎ বাংলার শিল্প সম্ভাবনাকেই বিনাশ করেছে। কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টচার্য একজন স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন এক নয়া সমাজব্যবস্থার। স্বপ্ন দেখতেন তরুণ সমাজের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করার।
Comments :0