ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় আড়াইটে। এই শহরে তখনও ৩১ নম্বর আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ঠিকানাকে ছুঁয়ে আলপনার মতো ছড়িয়ে রয়েছে জনস্রোত।
সুনীল-শক্তির কলমে অন্ত্যমিলের অপেক্ষায় বসে না থাকা পাঠকের মনে যেভাবে ছুঁয়ে থাকে অক্ষরমালা, যেভাবে মাটিতে পা রেখে আকাশছোঁয়া স্পর্ধা ছুঁয়ে আসে বক্রেশ্বর থেকে হলদিয়া হয়ে সেক্টর পাঁচে, আলখেত থেকে কারখানার গেটে, সেইভাবেই তখন এঁকে বেঁকে চলা জনপ্লাবনের মোহনাতে এসে ধাক্কা দিচ্ছে জনস্রোত!
মোহনায় তখন লক্ষ প্রাণের ছোঁয়ায় চিবুক বেয়ে নেমে আসা নোনা জলের স্রোতে জননেতার ছবি আগলে ঠায় দাঁড়িয়ে নাজিরা বেগম। পারবেন শেষবারের জন্য দেখতে তাঁকে? ‘‘জানি না। তবুও। না পারলে এখান থেকেই আবার হাঁটা শুরু করবো এনআরএসের দিকে।’’ উদয়নারায়ণপুরের বাসিন্দা। এখনও শাসকের সন্ত্রাসে দমবন্ধকর অবস্থা। স্বামী পরিযায়ী শ্রমিক। বাড়িতে একমাত্র সন্তানকে রেখেই ভোরবেলায় রওনা দিয়েছেন। ‘‘আমি এখনও একাই বুথে বসি। হারবো না কিছুতেই। লাখো মানুষ যে টানে এসেছে, সেই টানেই তো আমিও দাঁড়িয়ে আছি। লাল পতাকায় ঢেকে যাচ্ছেন আমাদের নেতা। আমরা হাঁটবো। জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বাংলাকে ফেরাতেই হবে এই বাংলায়।’’
কী মনে হচ্ছে? কবিতা শুনছেন। নিশ্চিত না। বেশিদূর পড়াশুনো করতে পারেননি। স্রেফ জীবনযুদ্ধ তাঁকে টেনে এনেছে এমনই উপসংহারে। এরপরে ইশারা করলেন দীনেশ মজুমদার ভবনের দিকে। ‘‘ওই দেখুন কী লেখা’’। টাঙানো ব্যানারে যেন নাজিরা বেগমের উপসংহার– ‘কমরেড, সময় এসেছে বিদায় জানাবার / হাজার হাজার জাগছে চোখ, শক্তি নিয়ে স্বপ্ন দেখার’।
তার কিছু পরেই জনপ্লাবনের স্রোতে ভেসে মরদেহবাহী শকট দীনেশ মজুমদার ভবনকে শেষবারের মতো ছুঁয়ে এগোচ্ছেন কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য— সেনাপতি, এক কমিউনিস্ট। স্থির বিশ্বাসকে এঁকে দিয়ে ব্রিগেডের জনসভায় তাঁর ডাকে কেন্দ্র-রাজ্যের দুঃশাসনকে পরাস্ত করার আহ্বান শুনেছিল এই বাংলা- ‘‘এই লড়াই লড়তে হবে, এই লড়াই জিততে হবে’’। অমীমাংসিত সেই লড়াইয়ের শপথের উষ্ণতাই শোকের শীতলতাকে ছাপিয়ে দিনভর দেখলো স্বপ্নদ্রষ্টা এক কমিউনিস্ট নেতার শেষযাত্রা।
পিস ওয়ার্ল্ড থেকে বিধানসভা হয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তর হয়ে, দীনেশ মজুমদার ভবন ছুঁয়ে মৌলালি পেরিয়ে এনআরএস হাসপাতাল— জনস্রোতেই শেষ বিদায় জননেতাকে। যে কমিউনিস্টের জীবনবোধকে মলিনতা, সঙ্কীর্ণতা ছুঁতে পারেনা সেই জীবনকেই বিদায় জানিয়েছে লক্ষ মানুষের ভিড়ে ইন্টারন্যাশনালের সুরে। ‘গান স্যালুট’র সরকারি প্রস্তাবকে ছাপিয়ে রেড স্যালুটেই বিদায়।
দুপুর তিনটে পনেরো। তখনও আলিমুদ্দিনের গলি পেরিয়ে মৌলালি মোড় পর্যন্ত মানুষের সারিবদ্ধ লাইন। কারো চোখে জল, কারো হাতে মালা, ফুল। কিন্তু সামনে এগনোর জো নেই। ছোট্ট শিশু মায়ের হাত ধরে সেই লাইনে। —তুমি চেনো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে? —‘‘সিএম ছিলেন। মা বলেছে প্রণাম করতে। মা বলেছে, রেসপেক্ট জানানোর লোক কমে যাচ্ছে।’’ সেই শিশুকন্যা শেষপর্যন্ত পেরেছিলেন সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তর পর্যন্ত পৌছতে? জনস্রোতের ধাক্কায় তা আর জানা যায়নি।
সাতসকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন ৭৫বছরের কৃষ্ণপদ হালদার। ফলতার আহম্মদিপুরের বাসিন্দা। ‘‘টাকা ছিল না, দু’শো টাকা একজনের কাছ থেকে নিয়ে সকালেই বেরিয়ে এসেছি।’’ পাঞ্জাবির পকেটে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের এক পুরনো মলিন হয়ে যাওয়া ছবি। সন্ত্রাসদীর্ণ ফলতা থেকে কার্যত লুকিয়েই এসেছেন। কেন? —‘‘না আসলে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে যাবো। আমার পার্টির নেতা, আসবো না, হয় কখনও! ওরা কত ষড়যন্ত্র কত আক্রমণ করেছিল ওঁকে।’‘ কথোপকথন থেকে কয়েক হাত দূরেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন তৃণমূল সরকারের পুলিশের হাতে খুন হওয়া শহীদ ছাত্রনেতা আনিস খানের বাবা সালেম খান। —‘‘না এসে পারিনি বাবা। আনিসদের স্বপ্নের জন্যই এই পার্টিটা, বুদ্ধদেব বাবুরা লড়েছিল। কারখানা হলে তো কাজ হতো। আনিসরা তো সে দাবিই তুলতো।’’
জনস্রোতের প্রতিটি তরঙ্গে নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা। শেষযাত্রার প্রতিটি মুহুর্ত আসলে যেন সেই আকাঙ্ক্ষাকে, শপথের স্লোগানকে অনায়াস বীজ, সার, জলের জোগান দিয়ে গেল, আরও একবার।
বিধানসভা ভবন থেকে বারোটা নাগাদ সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তরে যখন প্রবেশ করছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিথর দেহ নিয়ে আসা শকট, তখনই গোটা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ছাপিয়ে ভিড়ের বৃত্ত দখল করেছে এজেসি বোস রোড। সংগঠিত কোন মিছিল নয়, একের পর এক স্বতঃস্ফূর্ত ঢেউ। টেউয়ের পরে আরও ঢেউ। অবরুদ্ধ গোটা তল্লাট। অবশিষ্ট শহরের সব গন্তব্যের ঠিকানা তখন মুজফ্ফর আহ্মদ ভবনকে কেন্দ্র করেই। দাঁড়িয়ে পড়েছে বাস, গাড়ি। নেমে পড়ছেন মানুষ। একটিবার যদি দেখা যায় প্রিয় নেতাকে, নতুন বাংলা গড়ার স্বপ্নদর্শীকে। একটিবারের জন্য। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত শোকাহত মানুষকে সুশৃঙ্খলভাবে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ করে দিতে বসাতে হয়েছে ব্যারিকেড। তা মেনেই শৃঙ্খলিত সারিবদ্ধ মানুষের ঘণ্টার পর ঘণ্টার অপেক্ষা।
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্যরা কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মরদেহ লাল পতাকায় ঢেকে দিয়েছেন। একে একে সকলে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। শুধু সিপিআই(এম) বা বামপন্থী দলগুলি নয়, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, দলমতনির্বিশেষে সাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনেই শেষযাত্রা কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। সীমারেখা ভেঙেই তো সেদিন সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি বলেছিলেন, ‘‘রাজ্যে শিল্প হলে কী আমার ব্যক্তিগত কোনও লাভ ছিল? শুধু সিপিআই(এম)র লোকেরা চাকরি পেতো? এটা হয় কোনদিন? এরাজ্যের ছেলেমেয়েরা এরাজ্যেই কাজ করবে, তাঁদের মেধাকে ব্যবহার করবে।’’
সেই উচ্চারণের অনুরণন প্রেসিডেন্সির বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র বিতান ইসলাম, অর্পণ চক্রবর্তীর গলায়। রাতভর জেগে ফেস্টুন তৈরি করে সাতসকালেই হাজির ছাত্র-যুব অফিসের সামনে। ‘‘উনি তো কেবল প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী ছিলেন না, তিনি আমাদের প্রজন্মের ভাষা, স্বপ্নকে অনুবাদ করেছিলেন।’’
‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ থিসিসের কাজ ফেলে রেখে এসেছি। কারণ এই মানুষটা আমাদের জন্য যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেগুলি বাস্তবায়িত না হলেও, ভাবনায় কোন ভুল ছিল না। আমি নিজে কৃষির ছাত্র। আমি জানি কৃষির আধুনিকীকরণ যথেষ্ট নয়। চাই শিল্প।’’ —জনপ্লাবনে মিশে মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন কোচবিহারের বাসিন্দা উত্তরবঙ্গ কৃষি বিদ্যালয়ে গবেষণারত গৌরীশঙ্কর নন্দী।
পার্টির রাজ্য দপ্তর থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্ব আধ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে পেরিয়ে ষাট-সত্তরের ছাত্র-যুব আন্দোলনের আঁতুড়ঘর দীনেশ মজুমদার ভবন হয়ে মিছিল এগচ্ছে এনআরএস হাসপাতালের দিকে। আদৌ তাকে কী মিছিল বলা যায়? ব্যারাজের লকগেট খোলা জলস্রোতের মতই গোটা এজেসি বোস রোড ধরে স্লোগানে, গানে ভেসেই হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগের সামনে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিথর দেহ।
কবির উচ্চারণে— ‘‘...পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নূতন উঠবে ফুটে/ জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে।’’
Buddhadeb Bhattacharya's last rite
শোকের শীতলতা ছাপিয়ে শপথের উষ্ণতা
×
Comments :0