গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতের উন্নতি চান? তাহলে বৈষম্যে লাগাম টানুন। এই মর্মে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করল নেচার পত্রিকা।
জুলাই মাসে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে ২০১৫ সালে রাষ্ট্রসংঘের ‘সাসটেইনেবেল ডেভেলপমেন্টাল গোল-২০১৫’ কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭টি মানব উন্নয়ন সূচকে অগ্রগতির লক্ষস্থির করা হয়। সামগ্রিক ভাবে বিশ্বজুড়ে কিছু অগ্রগতি হলেও তাল কাটে কোভিড হানার পরে।
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে গবেষকরা জানাচ্ছেন, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে সবথেকে বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন বৈষম্য এবং অনুন্নয়ন ঠেকানোর বিষয়ে। নেচার পত্রিকার সম্পাদকীয়তেও উঠে এসেছে একই অভিমত।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে কোভিড হানা দেয়। কোভিডের হামলায় সারা বিশ্ব জুড়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে। গোটা বিশ্ব ব্যস্ত হয়ে পড়ে কোভিডকে সামলাতে। এই অবস্থায় টিবি প্রতিরোধের বরাদ্দ হ্রাস পায় ১০ শতাংশ। সারা বিশ্বের হিসেবে ৬ বিলিয়ান মার্কিন ডলার থেকে সেই বরাদ্দ কমে দাঁড়ায় ৫.৪ বিলিয়ন ডলারে। অপরদিকে টিবি আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৪ লক্ষ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ লক্ষে। একই সময়কালে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১২ শতাংশ হারে। রাষ্ট্রসংঘের তথ্য বলছে, শিশুদের ডিপথেরিয়া, টিটেনাস এবং পারটুসিস টিকাকরণের হারও কোভিডের সময় হ্রাস পেয়েছে উদ্বেগজনক হারে।
স্বাস্থ্যের পাশাপাশি কোভিডের সময় শিক্ষাক্ষেত্রেও বেসামাল হয়ে পড়ে। আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ কোভিড এবং লকডাউনের ফলে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ছিটকে যায়। দীর্ঘদিন স্কুল ও কলেজ পরিকাঠামোর বাইরে থাকায় বৃদ্ধি পায় স্থায়ী ড্রপআউটের সংখ্যা। এই স্কুল ছুটের ফলে তৈরি হওয়া সামাজিক ক্ষত দ্রুত চোখে না পড়লেও, দীর্ঘমেয়াদে তা প্রকট হতে বাধ্য। কারণ রাষ্ট্রসংঘের গবেষকরা জানাচ্ছেন, অনগ্রসর অংশের ছাত্রীরা যত বেশিদিন শিক্ষাক্ষেত্রে থাকে, ততই তাঁদের মধ্যে কমবয়সে গর্ভধারণ কিংবা এইড্স’র মতো রোগের প্রবণতা কমে।
জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীদের অভিমত, সুস্বাস্থ্য কেবলমাত্র জিন কিংবা পুষ্টির উপর নির্ভরশীল নয়। বরং তা বেশিমাত্রায় পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া, প্রকৃতি, অর্থনীতি এবং অসাম্য কিংবা সাম্যের উপর নির্ভরশীল। কোভিড পরিস্থিতি চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়েছে। কোভিডের সময় গোটা বিশ্ব সাক্ষী থেকেছে ভ্যাক্সিন অসাম্যের। ধনী দেশগুলির সম্পদশালী অংশের মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি দফায় ভ্যাক্সিন নিয়েছেন। অপরদিকে আফ্রিকা, এশিয়া কিংবা লাতিন আমেরিকার বহু দেশের জনসাধারণকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে থাকতে হয়েছে ভ্যাক্সিনের একটি মাত্র ডোজের জন্য।
লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের জনস্বাস্থ্য বিভাগের গবেষক সারা হকস্’র কথায়, ‘‘আগামী দিনে নীতি নির্ধারণের আগে কোভিডের সময়ের অভিজ্ঞতা মাথায় রাখা প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের সামাজিক স্মৃতি থেকে কোভিডের অভিজ্ঞতা অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। তারফলে কোভিডের ভয়াল সময়ের অভিজ্ঞতাগুলি থেকে আমরা শিক্ষা নেওয়ার কথা বিবেচনার মধ্যেই আনছি না।’’
জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা জানাচ্ছেন, সারা বিশ্বে নাগরিক স্বাস্থ্যকে মজবুত করতে প্রয়োজন অর্থনৈতিক অসাম্যকে নিয়ন্ত্রণে আনা। নাগরিক স্বাস্থ্যের দৈন্যতা কমাতে গেলে দারিদ্র, বৈষম্য, দারিদ্র থেকে জন্ম নেওয়া অপরাধ কমানোর উপরেও জোর দিতে হবে। এই বিষয়গুলিকে নির্মূল করার জন্যও বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
চলতি বছরের মে মাসে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে বিষদে তুলে ধরা হয়েছে, পৃথিবী জুড়ে সুস্বাস্থ্য লাভের জন্য কোন কোন অর্থনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন। সেখানে স্পষ্ট ভাষায় কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি এবং অতি-ধনীদের আরও বেশি করের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও জানিয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দকে কোনওভাবেই কোষাগারের উপর বোঝা হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং, দেশের ভবিষ্যত উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় লগ্নি হিসেবে দেখা উচিত স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বরাদ্দকে। এই মনোভাব নিয়ে চললে আর কৃচ্ছসাধনের নামে স্বাস্থ্যক্ষেত্রের ব্যায়বরাদ্দ হ্রাসের কথা ভাববেন না নীতি নির্ধারকরা।
Comments :0