রাজ্য সরকারের হুঁশ নেই। ব্যাঙ্কের ঋণ বেশিরভাগ নিয়ে যাচ্ছেন গ্রাম-শহরের উচ্চবিত্তরা।
তফসিলি জাতি, আদিবাসী, অন্যান্য অনগ্রসর অংশের মানুষ রাজ্যের মতো জনসংখ্যার পঁয়তাল্লিশ শতাংশ। এর বাইরেও একাংশের মানুষ আছেন, যাঁরা আর্থিকভাবে পিছিয়ে রয়েছেন। সব মিলিয়ে রাজ্যে আর্থিক, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ প্রায় ৬৩ শতাংশ। কিন্তু চাষের জন্য হোক কিংবা ক্ষুদ্র শিল্প কিংবা স্বনির্ভরতা, আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশই ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাচ্ছেন কম। চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ছয় মাসে সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষ পেয়েছেন মোট ব্যাঙ্ক ঋণের মাত্র ১৪ শতাংশ।
রাজ্য সরকার কিছু জানেই না, তা নয়। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কিংবা রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সূত্রেই ঋণ দেওয়া হয়। তার জন্য সরকারের অনুমোদন লাগে। কিছু ক্ষেত্রে সরকারকে ভরতুকিও দিতে হয়। ফলে সরকার জানতে পারে, কে কত কোন প্রকল্পে ঋণ পাচ্ছেন। সরকারের ভাষায় তাঁরা ‘উপভোক্তা’।
নাবার্ডের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, ''সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ, ভরতুকি দেয়। সেগুলি ব্যাঙ্ক মারফত দেওয়া হয়। আবার কৃষক বন্ধুর মতো বেশ কিছু প্রকল্পে সহায়তার টাকাও ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই মানুষ পান। রাজ্য সরকারের ঘোষিত প্রকল্পগুলির হাল কী, সরকার আদৌ কতটা ভরতুকি দিল, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড কিংবা ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের মতো প্রকল্পের সুবিধা আসলে কত জন পাচ্ছেন, তার বিশ্লেষণ হতে পারে স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটির বৈঠকেই। আবার ব্যাঙ্কগুলিও নিজেদের উদ্যোগে কোন কোন ক্ষেত্রে ঋণ দিচ্ছে, তা রাজ্য সরকার জানতে পারে।’’
রাজ্যে যে রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি, সমবায় ব্যাঙ্কগুলি আছে, তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের তিন মাস অন্তর পর্যালোচনা বৈঠক হয়। আগামী সোমবার তেমনই একটি বৈঠক হওয়ার কথা। সেই বৈঠকের জন্য যথারীতি একটি রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। রাজ্যের অর্থ দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই রিপোর্ট অনুসারে চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর, এই ছয় মাসে চাষ, ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্প, মৎস্যচাষ, পশুপালনের মতো অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে যা ঋণ দেওয়া হয়েছে ব্যাঙ্কগুলি থেকে, তার মাত্র ৩৮ শতাংশ পেয়েছেন সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষ। বাকি ৬২ শতাংশ পেয়েছেন তাঁরা, যাঁরা শহরের উচ্চবিত্ত কিংবা গ্রামের নব্য ধনী। এই অংশের হাতেই রয়েছে পঞ্চায়েত, পৌরসভা। আবার সরকারি প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ হাসিল করে এরাই হচ্ছে সুবিধাভোগী অংশ। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের এবং ছোট শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ এদের হাতেই।
ব্যাঙ্ক এবং রাজ্য সরকার যৌথভাবে যে রিপোর্ট তৈরি করেছে, তাতে জানা যাচ্ছে, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৫ লক্ষ ৯৪ হাজার ২৩ জন আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা ব্যক্তি ব্যাঙ্ক থেকে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে ঋণ পেয়েছেন। তাঁরা ঋণ পেয়েছেন ২৪ হাজার ৫৬৩ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ একেকজন গড়ে ব্যাঙ্কের ঋণ পেয়েছেন ৯৫ হাজার টাকার কম। কিন্তু সম্পন্নরা ঋণ পেয়েছেন অনেক বেশি। রাজ্যের অর্থ দপ্তরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, ‘‘বাকিদের সংখ্যা ২০ লক্ষ ৫৭ হাজার ৮১২। কিন্তু তাঁরা ব্যাঙ্ক ঋণ পেয়েছেন ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা।’’
অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে মোট ঋণ দেওয়া হয়েছে ১ লক্ষ ৭৩ হাজার ৫১ কোটি ৮৯ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে সম্পন্নরা পেয়েছেন প্রায় ৮৬ শতাংশ, ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা।
রাজ্যের অন্তত ২৮ শতাংশ মানুষ সংখ্যালঘু। তাও ২০১১-র জনগণনা অনুসারে। সংখ্যায় প্রায় ৩ কোটি মানুষ সংখ্যালঘু। সরকারি প্রকল্প সহ কোনও না কোনও ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ঋণ পেয়েছেন ১১ লক্ষ ৩০ হাজার ২০৪ জন। সেই সংখ্যালঘু মানুষদের পাওয়া মোট ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৩৮ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের বিরাট অংশ, প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কোনও সাহায্য পাননি।
সেই ২০১১-র জনগণনা অনুসারে রাজ্যে তফসিলি জাতির মানুষ ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ রাজ্যে তফসিলি জাতির মানুষ প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ। দশ বছরের পুরানো সেই জনগণনা অনুসারেই রাজ্যে আদিবাসী আছেন ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৫০ লক্ষের মতো আদিবাসী আছেন। তফসিলি জাতি এবং আদিবাসীদের সম্মিলিতভাবে জনসংখ্যার ২ কোটি ৮০ লক্ষের আশপাশে। অথচ এই দুই অংশের মাত্র ১.৩৩ শতাংশ অর্থাৎ ৩ লক্ষ ৭৩ হাজার ১৩০ জন ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ঋণ, সহায়তা পেয়েছেন। একই অবস্থা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষেরও।
Loan Backward
রাজ্যে পিছিয়ে থাকা মানুষই ৬৩ শতাংশ, ঋণ পেয়েছেন মোট বরাদ্দের মাত্র ১৪%!
×
Comments :0