বিশ্বজিৎ দাস, গুয়াহাটি
জেলায় জেলায় কারফিউ জারি করে, একাধিক থানা এলাকায় আফস্পা জারি করেও মণিপুরকে শান্ত করা যাচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। রাজধানী ইম্ফল পুরোপুরি বিক্ষুব্ধ জনতার দখলে চলে গিয়েছে। মেইতেই জনগোষ্ঠীর তিন শিশু ও তিন মহিলার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ও রাজ্যে ফের আফস্পা জারির বিরুদ্ধে রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইরা প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন। শনিবার থেকেই রাজধানী ইম্ফল সহ বিভিন্ন জেলায় তাণ্ডব চলছে। রবিবার কারফিউ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন। এদিনও আরও দুই মন্ত্রীর বাড়ি, বিজেপি ও কংগ্রেসের কয়েক জন বিধায়কের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে উন্মত্ত জনতা। মন্ত্রী থনজাম বিশ্বজিৎ সিং ও গোবিন্দ কান্তৌজামের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। ইম্ফলের প্রাণকেন্দ্রে থাকা আরএসএস’র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিও জ্বালিয়ে দিয়েছে জনতা। আরএসএস’র কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে বিজেপি কার্যালয়ের দিকে যাওয়ার পথে বিক্ষুব্ধ জনতাকে আটকায় পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী। আরেক দল মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিঙের পৈতৃক বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে রওনা হলে একশো মিটার আগে তাদের পথ আটকায় নিরাপত্তা বাহিনী। থাওবাল জেলায় বিজেপি বিধায়ক পাওনাম ব্রজেন, পশ্চিম ইম্ফল জেলার কংগ্রেস বিধায়ক থনজাম লোকেশ্বরের বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। জিরিবামে বিজেপি’র কার্যালয়ও পুড়িয়ে দিয়েছে জনতা। মেইরা পাইবির মহিলারা ইম্ফলের রাজপথ দখল করে অনশন করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে রবিবার সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে হাজার খানেক সিআরপিএফ জওয়ান ও সশস্ত্র পুলিশ ইম্ফলের রাস্তায় ফ্ল্যাগমার্চ করে। তবে জনতার ক্ষোভ দেখে পুলিশও পিছু হটছে। আবার রবিবার সকালে আসাম-মণিপুর সীমান্তবর্তী এলাকায় বরাক নদীতে এক মহিলার দেহ উদ্ধার হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। তবে এই দেহ নিয়ে মণিপুর কিংবা আসাম পুলিশের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।
এদিকে, মণিপুর হাতছাড়া হচ্ছে টের পেয়ে অবশেষে টনক নড়েছে মোদী-শাহর। শনিবার বিকেল থেকে মুখ্যমন্ত্রীর লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায়, রবিবার সকালে শরিক এনপিপি’র আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ও দলের একাংশের বিধায়ক ইস্তফা দেওয়ার কথা ঘোষণা করায় মহারাষ্ট্রে নির্বাচনী প্রচার মাঝপথে বন্ধ রেখে রবিবার তড়িঘড়ি দিল্লি ছুটে যান অমিত শাহ। এদিন মহারাষ্ট্রের বিদর্ভে দু’টি নির্বাচনী জনসভা ছিল শাহর। কিন্তু সব ফেলে এগারোটার মধ্যে তিনি দিল্লি পৌঁছান। দিল্লি পৌঁছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক, উত্তর-পূর্বের দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দা বিভাগের আধিকারিক এবং তিন সেনা কর্তাকে নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন শাহ। বৈঠক চলাকালীনই সেনাবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) অভিজিৎ পান্ডেরকর ও সিআরপিএফ’র ডিজি অনীশ দয়াল সিংকে মণিপুরে পাঠানো হয়। তাঁরা দু'জনই সন্ধ্যায় ইম্ফল পৌঁছান। মণিপুরে বীরেন সিং সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ যেভাবে খেপে উঠেছেন, তাতে সরকার পরিচালনা করা আর সম্ভব নয় বুঝতে পেরে সরকার ভেঙে রাষ্ট্রপতি শাসনের পথে যেতে পারে মোদী সরকার, শনিবারই এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। রবিবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের গতিবিধি ও সেনাকর্তাদের জরুরি ভিত্তিতে ইম্ফল পাঠানোয় সেই আভাস আরও স্পষ্ট হয়েছে। জানা গিয়েছে, সোমবার দিল্লিতে আরও একটি জরুরি বৈঠক করবেন শাহ। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, মণিপুরে জাতি হিংসা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে রাজ্য সরকার ভেঙে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি জানিয়ে আসছিল বিরোধী কংগ্রেস। কিন্তু আচমকা রবিবার তাঁরা এই দাবি থেকে সরে এসেছে। এদিন ইম্ফলে সাংবাদিক বৈঠক করে কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইবোবি সিং বলেন, রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করার পথে হাঁটছে কেন্দ্র। এমন ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। তবে রাষ্ট্রপতির শাসন রাজ্যের মানুষ মেনে নেবেন না। প্রধানমন্ত্রী মোদী মণিপুরের ঘটনায় হস্তক্ষেপ না করলে শাসক ও বিরোধী সব বিধায়কের ইস্তফা দেওয়া উচিত। প্রয়োজনে সময়ের আগে সরকার ভেঙে নির্বাচন করানো হোক। কংগ্রেস তাতে রাজি আছে। রাষ্ট্রপতির শাসনের দাবি থেকে কংগ্রেসের সরে আসার পেছনে মনে করা হচ্ছে, কাশ্মীরের মতো মণিপুরে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করে কেন্দ্রের হাতে মণিপুরের ক্ষমতা নিয়ে আগামী কয়েক বছর কাটিয়ে দিতে পারে মোদী সরকার। এতে কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসা এই মুহূর্তে সম্ভব হবে না। তাই রাষ্ট্রপতির শাসনের বদলে এখনই নির্বাচন চাইছে কংগ্রেস। শনিবার তিন দেশ সফরে বেরিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তিনি দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত মণিপুর নিয়ে একা কোনও সিদ্ধান্ত অমিত শাহ নেবেন কি না, এই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। এদিকে, রাজ্য জুড়ে আগুন জ্বললেও মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের খোঁজ নেই। শনিবার ইম্ফলে উন্মত্ত জনতার তাণ্ডব দেখে বীরেন সিংকে গোপন জায়গায় সরিয়ে নেন তাঁর নিরাপত্তা রক্ষীরা। কিন্তু তিনি কোথায়, কেউ জানেন না। দু’দিন আগেও যিনি ঘন্টায় ঘন্টায় সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন, শনিবার থেকে সোস্যাল মিডিয়ায়ও সেই তাঁর উপস্থিতি নেই। অন্যদিকে, বীরেন সিং সরকারকে ভেঙে দেওয়ার দাবি তুলেছেন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা। তিনি রবিবার বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, বীরেন সিং সরকার মণিপুরে সরকার পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে। তাই এই সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে তাঁর দল এনপিপি। বীরেন সিং সরকারকে শীঘ্রই বরখাস্ত করা হোক। উল্লেখ্য, শনিবার বিজেপি সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার ইঙ্গিত দেয় এনপিপি। রবিবার দলের সাত বিধায়কের স্বাক্ষর করা চিঠি রাজ্যপালের কাছে পাঠিয়ে সমর্থন প্রত্যাহারের কথা জানান দলের পরিষদীয় নেতা জয়কুমার সিং। এই নিয়ে বিজেপি’র দ্বিতীয় শরিক সঙ্গ ছাড়ল। বছর খানেক আগে কুকি পিপলস পার্টি বীরেন সিং সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে। এদিকে নতুন করে মণিপুরে হিংসায় উত্তপ্ত হওয়ায় ফের নরেন্দ্র মোদীকে কাঠগড়ায় তুলেছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। তিনি রবিবার বলেছেন, ‘‘মণিপুর যখন জ্বলছে, তখন বিদেশ ভ্রমণ করছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ক্ষমতা ও বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না।’’
Comments :0