মণিপুরে যা ঘটছে তা সাম্প্রদায়িক হিংসাই কেবলমাত্র নয়, বরং রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট হিংসা। মণিপুরে বিভিন্ন ঘটনাস্থল, ত্রাণশিবির ঘুরে এমনই জানিয়েছে মহিলা সংগঠন এনএফআইডব্লিউ’র তথ্য অনুসন্ধানী দল।
তথ্য অনুসন্ধানী দলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, মার্চ এবং এপ্রিলে কুকি এবং মেইতেই গোষ্ঠীর একাধিক সংঘাত চলছিল। ৩ মে থেকে মণিপুরে হিংসা আচমকাই মাথাচাড়া দেয়নি। কিন্তু রাজ্যের বিজেপি সরকার বিদ্বেষ কমানোর চেষ্টা করেনি, উলটে বিদ্বেষে মদত দিয়েছে।
গত সোমবার কুকি জনজাতিদের দু’টি গোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ডিমাপুর-ইম্ফল জাতীয় সড়ক-২’র উপর চলমান ৬০ দিনের অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। তার পরপরই বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের একজনের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
কুকি-জো সিভিল সোসাইটি সংগঠন এবং ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট (ইউপিএফ) এবং কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (কেএনও)’র প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ১৯ সদস্যের একটি দল ৩০ জুন আসামের কাজিরাঙ্গায় বিজেপি’র একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে দেখা করেন। তারপর রাস্তার অবরোধ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। রাজ্যের সমস্ত অংশে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
সোমবার রাতে কেএনও মুখপাত্র সিলেন হাওকিপের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আদিবাসী ট্রাইবাল লিডারস ফোরামের মিডিয়া টিমের মতে, বাড়িটি ‘‘অজ্ঞাত পরিচয় দুর্বৃত্তরা’’ পুড়িয়ে দিয়েছে।
পাশের রাজ্য মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা মণিপুরে শান্তির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে পরিস্থিতি কেবল খারাপ হচ্ছে। তিনি বলেছেন, “যদিও আমরা অনেক সদিচ্ছা, প্রত্যাশা নিয়ে আছি, কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে মনে হচ্ছে। কখন থামবে এই অরাজকতা? আমি আমার মণিপুরি ভাইদের সমবেদনা জানাই, যাঁরা তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে, তাঁদের বাড়িঘর এবং পরিবারগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে তাদের জন্য আমার অবিরাম প্রার্থনা রয়েছে।’’
একই দিনে, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা এন বীরেন সিং বলেছেন, ‘‘রাজ্যের সমস্ত বাঙ্কার ভেঙে ফেলা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সরকার ৫ জুলাই থেকে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কুকি গেরিলারা ব্যবহার করছেন তাঁদের নিজস্ব নিশান। সেই নিশানকে রক্ষা করতে গড়ে তুলেছে বাঙ্কার।’’
রাজ্য এবং তার বাইরেও বারবার ক্ষোভ জানিয়েছেন বীরেন সিংয়ের ভূমিকায়। এমনকি বিজেপি’র একাংশও তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন যে মেইতেই গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাত খুব স্পষ্ট মুখ্যমন্ত্রীর। কুকি জনজাতিকে আগাগোড়া হিংসার জন্য দায়ী করার চেষ্টা করছেন তিনি। সংঘাত না কমার অন্যতম কারণ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের এমন ভূমিকা।
সম্প্রতি বীরেন সিং সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গোটা অশান্তির দায় কুকিদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, মেইতেইদের কোনো দোষ নেই। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান আরও বলেছেন, কুকিদের মধ্যে অনেকেই অনুপ্রবেশকারী, তাঁরা মাদকের কারবারে যুক্ত।
বিভিন্ন অংশ বলছে যে মণিপুরের প্রেক্ষিতে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদ মেইতেই গোষ্ঠীকে সামনে রেখে চালাচ্ছে বিজেপি। কুকি-সহ 'জো' সংখ্যালঘুদের বিপক্ষে নামানো হয়েছে মেইতেইদের।
মণিপুরে ৩ মে থেকে জাতিগত হিংসায় ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। চল্লিশ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় শিবিরে।
তথ্য অনুসন্ধানী দল মনে করিয়েছে জমি এবং সম্পদের অধিকার নিয়ে বিবাদকে জাতিগত হিংসার দিকে ঠেলে দিয়েছে বিজেপি সরকার। আপাত বিচারে যদিও মণিপুর হাইকোর্টের একটি রায়ের পর বিবাদ তীব্র হয়। মেইতেইদের আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি রূপায়নে প্রক্রিয়া চালু করতে রাজ্যকে নির্দেশ দেয় আদালত।
উল্লেখ্য, রাজধানী ইম্ফল এবং সংলগ্ন এলাকায় বসতি মেইতেইদের। কুকি জনগোষ্ঠীর বাস বেশি পাহাড়ি অঞ্চলে। বিজেপি সরকার বনাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ করে বিভিন্ন অংশকে। মেইতেইরা আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে চিরাচরিত বসবাসের অঞ্চলে দখলদারি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তীব্র হয় কুকিদের মধ্যে। এর আগে সিপিআই(এম)-ও বলেছিল যে বনাঞ্চল থেকে উচ্ছেদ এবং সরকারের অসহিষ্ণু আচরণ ক্ষোভকে গভীর করেছে।
Comments :0