'Sabarmati Reported'

মোদীর সত্য কবে সামনে আসবে!

জাতীয়

 গোদীউডের পরের ধামাকা নিয়ে গদগদ প্রদানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ‘রাজধর্মের’ তোয়াক্কা না করা আজকে দেশের প্রধানসেবক প্রোপাগান্ডা ফিল্ম ‘সবরমতী রিপোর্টেড’-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এক্স হ্যান্ডলে লিখলেন, ‘‘সত্য সামনে আসছে।” শুক্রবার সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে। সিনেমার ট্রেলার এক্স হ্যান্ডলে শেয়ার করে এক অনুরাগী প্রধানমন্ত্রীকে ট্যাগ করেন। সেখানেই একথা লিখে দিয়েছেন মোদী। যেন, এতদিন যা কিছু জানা গিয়েছিল, তা সত্য নয় একেবারেই। 
দেশের ইতিহাস নতুন করে লেখার তোড়জোরের মধ্যে নিজের কালি মুছে ফেলার এমন এক ফিল্ম নিয়ে যে তিনি গলা চড়াবেন, তাতে অবশ্য তেমন অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। শুধু নিয়ম-রীতির তোয়াক্কা না করে একজন প্রধানমন্ত্রীর এমন ক্যাম্পেনিং নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। সাংবাদিক তথা দ্য ওয়ার-এর সম্পাদক সিদ্ধার্থ বরদারাজন যেমন মোদীর এহেন কাজকে ‘হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ মোদী একাজ তো প্রথম করছেন না! 
এর আগেও প্রধানমন্ত্রী বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এর মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করেছেন। লোককে বিষাক্ত বিষয়বস্তুতে ভরা সেই সিনেমা দেখতে বলেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘যে লোকগুলি সবসময় বাক্‌ স্বাধীনতার ঝান্ডা নিয়ে ঘোরেন, সেই গ্যাং গত পাঁচ-ছ’দিনে কেঁপে গিয়েছে। তথ্য, শিল্পের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করার পরিবর্তে সেই সিনেমাকে অস্বীকার জন্য প্রচার চলছে। পুরো একটা মহলের তরফে সেই কাজটা করা হচ্ছে। কেউ যদি সত্য ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানান....তাঁর যেটা সত্যি মনে হয়েছে, সেটা উনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সেই সত্যি স্বীকার করতে চাইছে না, বাকি দুনিয়া সেই সত্যের মুখোমুখি হোক, সেটাও চায় না।’
আবার সেই ‘সত্য’-র গাওনা গাইছেন মোদী। এদিন এক জনৈক এক্স হ্যান্ডেলে ছবির ট্রেলার শেয়ার করে বিস্তারিত লেখেন, কেন প্রত্যেক ভারতীয়ের এই ছবিটা দেখা উচিত। সেই পোস্ট নিজের ভ্যারিফায়েড এক্স হ্যান্ডেল থেকে শেয়ার করে প্রধানমন্ত্রী লেখেন, ‘ভালো বলেছেন। এটা ভালো যে এই সত্যিটা বেরিয়ে আসছে এবং সাধারণ মানুষও সেটা দেখতে পাচ্ছেন। একটি ভুয়ো কাহিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে। কিন্তু, সত্য সবসময় সামনে আসবে।!’
কী আছে এই ‘সবরমতী রিপোর্টে’। ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরা স্টেশনের কাছে সবরমতী এক্সপ্রেসের এস-৬ কামরায় আগুন লাগানোর ঘটনাকে ঘিরেই ‘সবরমতী রিপোর্ট’। যে ঘটনা গুজরাটে গণহত্যা সূত্রধর। ধীরজ সারনা পরিচালিত এই ছবি প্রযোজনা করেছেন শোভা কাপুর, একতা আর কাপুর, আমুল ভি মোহন এবং অংশুল মোহন। বিক্রান্ত মেসি ছাড়াও ছবিতে রয়েছেন রাশি খান্না এবং ঋদ্ধি ডোগরা। দেশের সংবাদ মাধ্যম যখন গোদী মিডিয়া হয়ে গিয়েছে, তখনই গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে পাবলিকে মগজ প্রক্ষালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে একসময়র বলিউড নাম কিনেছে গোদীউডের। সেই গোদীউডেরই সর্বশেষ প্রোডাকশন এই ‘সবরমতী রিপোর্ট’। গোধরার পুরানো ক্ষতকে খুঁচিয়ে তুলতে আরেক প্রোপাগান্ডা ফিল্ম। গোধরার সেই পোড়া এস ৬ কামরা তো শুধু গণহত্যা উসকে দেয়নি, বিদ্বেষ ছড়িয়ে বছরের পর বছর ডিভিডেন্ড এনে দিয়েছে বিভাজনের কারবারিদের। তেমনই ভোটবাক্সও ভরিয়েছে। বিজেপি তাই এমন ফিল্মের প্রচারে সরাসরিই নেমে পড়তে কুণ্ঠা বোধ করে না। 
আসলে কথা তো ছিল বিষের হাঁড়ি নিয়ে মে মাসের ৩ তারিখেই এসে পড়বে ‘দ্য সবরমতী রিপোর্ট’। কারণ তারপরও দেশে পাঁচ দফার ভোট বাকি থাকবে। কিন্তু ততদিনে মুসলিম ঘুসপেটিয়া, মঙ্গলসূত্র, গোরু-বলদ তুলে উনি নিজেই এমন বিষ ছড়ালেন, গোটা দেশ রে রে করে উঠেছিল। শেষে নিজেকে ‘নন-বায়োলজিক্যাল’ ঠাওরে সরাসরি ভোটে পরাস্ত হয়েও নতুন শরিক জুটিয়ে আবার তিনি প্রধানমন্ত্রী। স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসাবেই হয়তো থমকে ছিল ‘সবরমতী রিপোর্ট’। সমালোচকদের কথায়, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ডের ভোটের মুখে তাই হয়তো হিসাব করে এমন আত্মপ্রকাশ। আর যাতে অন্য খবরে আড়ালে চাপা পড়ে না যায়, তাই একেবারেই প্রধানমন্ত্রীর তা নিয়ে ক্যাম্পনিং শুরু।
এমন তরফদারি দেখে আর চুপ থাকতে পারেননি সিদ্ধার্থ বরদারাজন। এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘মোদীর এমন একটা টুইট সমর্থন করা হাস্যকর। যেখানে গোধরা ট্রেনে যাত্রীদের নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এবং তা একটি ‘রাজনৈতিক ফাঁদে পরিণত’ হওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে!’ সিদ্ধার্থ স্পষ্ট মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেই ‘স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী’ আর কেউ ছিল না, মোদী আর তার দল। এবং গোধরা হামলার পর যেসব নিরীহ মানুষ জীবন হারিয়েছিলেন, তাদের ক্ষতিকে মোদী যেভাবে ‘রাজনৈতিক ফাঁদ’ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, তা গুজরাটে আরও হাজারেরও বেশি নিরপরাধ মানুষের প্রাণ যেতে বাধ্য করেছিল। সেসময় তার নিজের প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী এই মোদীকে তার ‘রাজধর্ম’ মনে করিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেই সময়ে মোদীর নিন্দনীয় কার্যকলাপের জন্য তার বিচার হওয়া আজও ইতিহাসের অংশ।
তেমনই জনৈক জি শিকারিপুর এক্স হ্যান্ডেলে মোদীর পোস্ট নিয়ে লিখেতে গিয়ে কংগ্রেস নেতা এম কে বেণুর একটি মন্তব্যকে তুলে ধরেছেন। তাতে বেণু বলেছেন, ‘ট্রাম্পনোমিক্সই হবে মোদীর অগ্নিপরীক্ষা’। সেটি উল্লেখ করে শিকারিপুর লিখেছেন, মোদী ও শাহ ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘আওরঙ্গজেব’ আর এখন গোধরার ‘প্রেতাত্মাদের’ পুনরায় জীবিত করতে ব্যস্ত। ওরা কি ট্রাম্পনোমিক্সের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে আরও শক্তিশালী করার ছক করেছে?’
বিভাজনই যে আসল অস্ত্র সেটা আর বিশেষ চাপা নেই। কিন্তু আজকে মোদীর মন্তব্য আবারও প্রমাণ করে দিল, লক্ষ্য সংখ্যাগুরুবাদই কায়েম করা। ‘সত্য বেরিয়ে আসা’র ফাঁকে সেই আসল সত্যটাই বেরিয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদী-শাহের ভাষ্য মাফিক ‘সত্য’টাকে মেনে নেওয়াটাকেই ভবিতব্য হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। তা না হলে একসময়ে ‘সেকুলার’ মন্তব্যের জেরে গৈরিক বাহিনীর চক্ষুশূল হওয়া বিক্রান্ত মেসিই আজ এখন মোদী শিবিরের ‘ভরসা’। আর সেই ‘ভরসা’ বজার রাখতেই হয়তো এক সাক্ষাৎকারে বিক্রান্তকে বলতে হচ্ছে, ‘কত লোক বলে এদেশে নাকি হিন্দুরা সঙ্কটে, কই আমার তো সেটা মনে হয় না। আবার কেউ বলেন এদেশে মুসলিমরা সঙ্কটে। সেটাও কই দেখি না তো। আদপে কোথাও কেউ বিপদে নেই। যে যার নিজের মতো করে ভালো আছেন।’ 
পুনশ্চঃ, আমেদাবাদের সারখেজ কিংবা নারোদা পাটিয়ায় ঘুরলে অনেক ফেজটুপি পরা মানুষকেও এমনই বলার অভিজ্ঞতা হবে বই কী!
 

Comments :0

Login to leave a comment