ভাস্কর দাশগুপ্ত: পুরুলিয়া
সীমাহীন দারিদ্র, অনাহার, অপুষ্টি নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে বলরামপুরের শবরটোলা। গত তিনমাসে কার্যত বিনা চিকিৎসায় পরপর ৮জনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সকালে শেষ মৃত্যুটি হলো তেষট্টি বছরের বৃদ্ধ ভখম্ শবরের। শবরটোলার মানুষের দাবি, অপুষ্টিতে, না খেতে পেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে ভখম্ শবরের। নির্বিকার প্রশাসন, শাসক দল।
গত তিন মাসে ৮জন গরিব শবর জনজাতির মানুষের মৃত্যু হয়েছে পুরুলিয়া জেলার বলরামপুর ব্লকের বড় উরমা গ্রাম পঞ্চায়েতের হাড়জোড়া গ্রামে। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, গত তিনমাসে এই গ্রামে অপুষ্টি, অনাহারেই মারা গিয়েছেন, কালি শবর (৬৮), কংস শবর (৪৫), শঙ্কর শবর (৩৫), মথুর শবর (৫২), শুকু শবর (৫৫), গোপাল শবর (৩৫) ও অশোক শবর (৫৩)। এখনো অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী রয়েছেন দুই যুবক, বছর ছত্রিশের বুদ্ধেশ্বর শবর ও বছর চব্বিশের পেকু শবর। স্থানীয় সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থকরা ওই দুই শবর যুবককে বলরামপুরের বাঁশগড় ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।
গোটা শবরটোলায় ঘুরলে সীমাহীন দারিদ্রের ছবি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। মানুষগুলোর রেশন কার্ড আছে, কিন্তু আধার কার্ড নেই। আধার-লিঙ্ক হওয়ার কারণে তাঁরা কেউ তাই রেশন পান না। এদিকে, দু’বেলা ভালো করে খাবারও জোটে না। এই শবরটোলার কোনও শিশুই স্কুলে যায় না। বছর কয়েক আগে জেলা প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা এলাকায় সফর করে সমস্ত পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে এসেছিলেন। কিন্তু কোথায় কী? কর্তাব্যক্তিদের সফরই সার। এই শবর জনজাতির এই মানুষগুলোর অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। দারিদ্র, অশিক্ষা, অপুষ্টিতে ঢাকা হাড়জোড়া শবরটোলার শবর জনজাতির মানুষরা এখনো সভ্যতা থেকে পিছিয়ে রয়েছেন কয়েক যোজন।
হাড়জোড়া গ্রামের এই শবরটোলায় প্রায় ১৪০ শবর বসবাস করেন। এলাকার অধিকাংশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কোনও ভাতা বা পেনশন নেই। এমনকি, আবাস যোজনার ঘরও কেউ পাননি। কিছুদিন আগে জেলা শাসকের দপ্তরে গ্রাম থেকে দরবার করেও এসেছিলেন কয়েকজন। কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভেজেনি। অগত্যা কোনোরকমে ভাঙা ঘরে প্লাস্টিক টাঙিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন এই অসহায় মানুষগুলো। এলাকায় কোন কাজও নেই, তাই গ্রামে থেকে খেটে খাওয়ারও উপায় নেই। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার এলাকার আরও ১৬জন স্ত্রী-পুরুষ বর্ধমানে নাবাল বা পুব খাটতে চলে গিয়েছেন। এই গ্রামের বাসিন্দা ৪৫বছরের ডমন শবর ঘাটশিলায় কাজ করতে গিয়েছিলেন। গত কয়েক মাস ধরে তিনি নিখোঁজ। শবরটোলার অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তি করেই জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিন গ্রামে গিয়ে জানা গেল, ভখম্ শবরের বাড়িতে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু তাঁরও কোনও কাজ নেই। মেয়ের বিয়ে হওয়ার পর সেও ফিরে এসেছে বাপের বাড়িতে।
স্থানীয় বাসিন্দা সহদেব মাহাতো জানালেন, এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে কেউ কার্যত নেই। আবাস যোজনার সর্বশেষ তালিকাতেও এখানকার কোনও মানুষের নাম নেই। মানুষগুলো দু’বেলা ভালো করে খেতেও পারে না। চিকিৎসা করানো ওদের কাছে বিলাসিতা। অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসাতে মারা যাওয়ার ঘটনা তাই ঘটছে।
বলরামপুর ব্লকের বিডিও সৌগত চৌধুরিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, শবরটোলার মানুষ যাতে রেশন তুলতে পারেন, সেজন্য আধার কার্ডের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনের আধার কার্ড হয়েও গেছে বলে তাঁর দাবি। অপুষ্টি, বিনা চিকিৎসা প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ওই গ্রামের অনেককেই হাসপাতালে এনে চিকিৎসা করা হয়েছে। প্রশাসন ওদের পাশে আছে। কিন্তু এলাকার মানুষজনের দাবি, প্রশাসনের কেউ ওদের দেখে না। প্রয়োজনের সময় কেউ পাশে নেই।
Comments :0