অন্যকথা
‘হেমন্তের অরণ্য’ সংরক্ষিত হোক : ফুটে উঠুক ‘আকাশে সাতটি তারা’
সৌরভ দত্ত
মুক্তধারা
হেমন্ত মানে শিশিরের দেশ।শারদ পর্বের পর থেকেই হেমন্তের লাজুক পাতারা শিশির চোয়ানো ঠোঁটে দাঁড়িয়ে থাকে। ঝরাপাতারা খসে পড়ে। অন্যান্য ঋতুর মতো হেমন্তেরও কোনো লাইফটাইম নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ,শক্তি চ্যাটুজ্জে, কিংবা জীবনানন্দ কিংবা পাশ্চাত্যের এলিয়ট,শেলি,কিটস প্রমুখ কবিদের চেতনার চিত্রকল্প ফুটে ওঠে অদ্ভুত রহস্যময় হৈমন্তিক আলোক বিচ্ছুরণ।কত রিক্ত,শান্ত, সমাহিত কাল হেমন্ত। হেমন্ত মনে এক অন্যরকম বিষাদময় অভিঘাত সৃষ্টি করে।কখনো জীবন-মৃত্যুর রূপক ওঠে। পাশাপাশি এক মুগ্ধতা,সম্মোহনী নেশা হেমন্তের সৌন্দর্যময় প্রতিমূর্তি রচনা করে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর মতো কবি নীলাভ অক্ষরে লিখে ফেলেন–“হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান ” ।ওই কবিতাতেই বিয়োগান্তক অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে একটি জায়গায়–“একটি চিঠি হতে অন্য চিঠির দূরত্ব বেড়েছে কেবল/একটি গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি আমি।” হেমন্তের অরণ্যের সৌন্দর্যময় উপলব্ধিতে বিভোর হয়েছিলেন বোহেমিয়ান কবি। হেমন্তের রং হরিদ্রাভ।একলা অঘ্রাণ থেকে নবান্ন শুরু।ধানের উৎসব।রমণীকূল মেতে ওঠে লৌকিক সংস্কৃতিক লোকাচারে।মধ্যযুগের প্রখ্যাত কবি কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে হেমন্তের চিত্রাভাস পাওয়া যায়–“কার্তিক মাসে হয় হিমের প্রকাশ/জগজনে করে শীত নিবারণ মাস।” ব্যস্ত চরাচর জুড়ে কার্তিকের হিমেল পরিসরে হেমন্তের আবাহন রচিত হলেও তার গভীরেই থেকে যায় শীতের আগমনী সুর। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতাতেই আছে হেমন্তের নৈসর্গিক অনুষঙ্গ–‘‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে /জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে/ শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার রয়েছে /পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’’হেমন্তের নতুন ধানে গোলা ভরে ওঠে। যদিও এখন গ্রাম বাংলায় গোলা,মারাই এর দেখা মেলা দুস্কর।স্বর্গে গেলেও ধান ভানত যে ঢেঁকি–কালের নিয়মে সেও লুপ্ত।একদা হেমন্ত বছরের প্রথম মাস হিসেবে বিবেচিত হত। খামারে খামারে ধানঝাড়া।সুগন্ধি চাল। অঘ্রাণে হিজল গাছে এসে বসে লক্ষ্মী পেঁচা।সাক্ষী থাকে বুড়ি চাঁদ। মোহনীয় জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আঙিনায়। চলতি বাজারে নতুন নতুন শাক-সবজির আনাগোনা।হরেণবাবু বগলে কচি নটে-পালং ঝুলিয়ে ফেরেন। জীবনানন্দের প্রিয় ঋতু।
রূপসুন্দরী হেমন্তের প্রেমে মাতোয়ারা কবির চোখ বলে ওঠে–“প্রথম ফসল গেছে ঘরে/, হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/শিশিরের জল; অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে।” অনাবিল ভালোবাসার আর্তি তৈরি করে হৈমন্তির বাসনা। সোনালী শস্য ভরা মাঠ।কাটা ঘুড়ির দল লাট খায় আকাশে।কুয়াশার শিহরণ তৈরি করে ভৌতিক আবেশ। মহানগর এর রাস্তায় হেমন্তের হাওয়া বয়। মিটিমিটি তারারা ওঠে।ভিক্টোরিয়া , শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে থাকে একা। ঘোড়ারা ঘুরপাক খায় সহিসের অপেক্ষায়। হেমন্ত মানেই নিভু নিভু শীতের রেশ। ঠাণ্ডা লাগা, গলাব্যথা। কিছুটা পোস্ট কোভিড পরিস্থিতি। বর্তমানে দ্রুত নগরায়নে ফুরিয়ে যাচ্ছে হেমন্তের রোদেলা দিনগুলি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল দূষণের কালো ধোঁয়া প্রতিদিন ঢুকছে নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে। জলাভূমি, জঙ্গল বিপন্ন।চিনা মান্দায় রক্তাভলক্ষ্মীপেঁচা,শামুকখোল, কানিবকের ডানা। কুয়াশার চাদর মোড়া রাজপথে ট্রামে দের দেখা নেই আর।বন্ধ হয়ে গেছে শতাব্দী প্রাচীন ট্রামের চাকা। প্রবীণ নাগরিকদের প্রায়: ভ্রমণের মৃগয়াভূমি রবীন্দ্র সরোবরে বেআইনি প্রোমোটিংএ গলা তুলছে কংক্রিটের জিরাফ। গাছে গাছে নিভে গেছে জোনাকির আলো।শ্যামা পোকাদের দেখা নেই।মুনিশদের পেটে টান মারছে ধান ঝাড়া,ধান কাটা মেশিন।বদলে যাচ্ছে দুনিয়ার মানচিত্র।চেনা হেমন্ত তাই খানিকটা অচেনা। তবুও আজো কোনো রমণী উঠোনে হেমন্তের আলপনা আঁকে।শক্তি চ্যাটুজ্জে রহস্য করে বলেছিলেন–“হেমন্ত দরোজা ভেঙে নিয়ে আসে সবুজ নিঃশ্বাস/মানুষের মতো নয় রক্ত পিত্তে সৌভাগ্য সরল/শিশুটির মতো রাঙা ক্রন্দন ছড়িয়ে চারিপাশে/হেমন্ত যেখানে থাকে সেখানে কৌতূক থাকে গাছে।”
Comments :0