গল্প
অন্যগল্প : চৈতন্য
ময়ূরী মিত্র
মুক্তধারা
শ্রাবণ সংক্রান্তির জোরালো রোদের মধ্যেই মিনারভা হলে পরবর্তী শো এর ফর্ম তুলতে গিয়েছিলাম ৷ সেখান থেকে
গিরিশমঞ্চে ৷ ছোট দলে কাজ করার মস্ত আনন্দ কী জানেন --সবসময় নিজের মধ্যে একটা স্বাবলম্বী ও কর্মীভাব তৈরি হয় ৷
অর্থ ও সরকারি আনুকূল্যের অভাব সবসময় কানের কাছে বলতে থাকে --আরো খাটো -মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখে
থিয়েটারের সবটুকু কাজ করে যাও ৷ ইদানিং তাই অভিনয় ছাড়াও দলের এইসব কাজ টুকটুক করে করি ৷ আশা করে করি
৷ সে আশা কিছু সংস্কারমুক্ত পরিচ্ছন্ন মানুষকে পাশে পাওয়ার আশা ৷
শারীরিকভাবে যাওয়ার অবস্থা সেদিন ছিল না ৷ পেট খারাপ , জ্বর জ্বর ভাব ৷ গিরিশ মঞ্চ থেকে বেরিয়ে দেখলাম
, একটা রক্তস্রোত সবাক হয়ে ছুটে চলেছে ৷ বেশির ভাগ যুবক ও যুবতী ৷ স্কুল ড্রেসের মতো একরকম রক্তপোশাক করে
মাথায় কলস ভরা জল নিয়ে ছুটছে ৷ সঙ্গে অনেক বাচ্চা ৷ দুপুরবেলা যখন স্কুলের লাস্ট পিরিয়ড করার কথা তখন সেরফ
ধার্মিক বাবা মায়ের চাপে কপালে লাল টিপ লাগিয়ে গরম রাস্তায় খালি পায়ে ছুটছে বাচ্চাগুলো ৷ আবার জোর করে ধার্মিক
সাজানো বাচ্চাদের লাথির চোটে শেষবেলার দোকানীর আলু উচ্ছে গড়াগড়ি যাচ্ছে ৷ দোকানী কাতর মুখে কুড়িয়ে রাখছেন
সবজি ৷ দোকানীর পণ্য নষ্ট করে বাচ্চাদেরও কোনো হেলদোল নেই ৷ মিষ্টির দোকানের মালিকরা আবার নিজেরাই রাস্তায়
নেমে জল দিচ্ছে ৷ ধার্মিককে জলদান সোজা - তৃষ্ণার্তকে নয় ৷
হঠাৎ চিৎকারের মাত্রা বাড়ল ৷ পুলিশের গোটা দেহে সম্ভ্রম প্রদর্শন বাড়ল ৷ পুলিশটা বেশ ধার্মিক আছে তো ৷
এবার দেখলাম একদল হলুদ পোশাক পরা মানুষ ত্রিশূল মাটির সমান্তরালে বাগিয়ে ঘোর উন্মত্ত হয়ে ছুটছে ৷ ত্রিশূল সোজা
না রেখে বুকে ফোঁড়ার ভঙ্গি করে ছোটার মানে নিশ্চয় জানেন ! আগের সারির যে কোনো তীর্থযাত্রী একবার পিছন ফিরলে
প্রচণ্ড মোশনের মধ্যে যে কোনো মুহূর্তে ত্রিশূল দ্বারা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে পারে ৷ বিশেষ করে বাচ্চারা ৷ পুলিশকে বিষয়টি
বোঝাতে গেলাম ৷ এমনভাবে তাকালেন আমার দিকে -মনে হল আমি একটা সিকনি খাওয়া কাক ৷ বারবার যখন বিরক্ত
করতে লেগেছি তখন সেই ধার্মিক পুলিশের বক্তব্য --ধর্মে পলিটিক্স আনবেন না ৷ আমি কী পলিটিক্যাল কথা বললাম
বুঝতে যখন পারছি না যথেষ্ট বিজ্ঞতা ফাটিয়ে পুলিশ বলল---ওই দেখুন --ত্রিশূলের সাথে লোকনাথ ,হনুমানও যাচ্ছে ৷ ধর্মে
দু পার্টির কোনো ভেদ নেই ৷
বুঝলাম এরা ভগবান ভাগ করেছে ৷ রাজ্যসরকারের হলো যে বঙ্গউৎসব শ্রাবণ সংক্রান্তি আর কেন্দ্রীয়
সরকারের প্রোগ্রাম হল শিশুর মাথায় পুতুল হনুমান তুলে দেয়া ৷ শ্রাবণ সংক্রান্তি স্পেশাল ইভেন্ট বলে বোধহয় রাজ্য ভগবান
ও কেন্দ্রীয় ভগবানে ব্যাপক মিলেমিশ ৷
আমার শিশুরা যে শ্রাবণ সংক্রান্তির সৌন্দর্য --মানুষের মেলবন্ধন দেখার অপার আনন্দটুকু পেলে না - না বুঝে
এক অন্ধতার সিলেবাস প্র্যাক্টিস শুরু করল ---মাঝদুপুরে এই গ্লানি আমাকে আরো অসুস্থ করেছিল ৷ থপথপে শরীরটাকে
শ শ বছরের পুরনো মনে হয়েছিল ৷ চুপ করে ঘাটের দিকে যাত্রীদের একটি বসবার বেঞ্চে বসে রইলাম ৷ দেখলাম -- কজন
মজুর শ্রেণীর মানুষ সদ্য উনুন থেকে ভাত নামিয়ে খেতে বসেছে ৷ সঙ্গে একটা জলের মতো ডাল আর তালের সাইজের
আলুভাতে ৷ ছেলেবেলায় বলতাম --তালআলু ৷ একটু আশ্চর্য হলাম --এই মহামিছিলের সঙ্গে তাদের বিন্দুমাত্র যোগ
দেখলাম না ৷ গরস গরস মুখে পুরে যাচ্ছে ৷ রোদ ছিটকে তাদের ডাল ভাতকে আবার করে মেখে দিচ্ছে -সে খেয়ালও আছে
তাদের ? গল্প করে বুঝলাম এরপর দুপুরের শিফটের কাজে দৌড়বে ৷
বাড়ি ফিরে ঝাঁপিয়ে জর এল ৷ আর রাতে বৃষ্টি ৷ আচ্ছন্ন অবস্থায়ও মাথার মধ্যে দুপুরের বাচ্চাগুলোর ত্রিশুলের
ফাঁক দিয়ে দিয়ে চলার দৃশ্য মনে পড়ছিল ৷ মনে পড়ছিল শ্রমিক মানুষগুলোর আপন মর্যাদায় সামান্য খাবার খেয়ে আবার
কাজে ছোটা ৷ শুধু কোনটাকে আগামীতে মনে রাখা দরকার -- সেটা বুঝতে পারছি না ৷ না পারছি না ৷
এই দেখুন না - লিখতে বসে ফিনফিনে বেণীটা কুকুরের ল্যাজের মতো বেঁকিয়েই যাচ্ছি শুধু ৷
Comments :0