মধুসূদন চ্যাটার্জি: বাঁকুড়া
‘‘গাঁয়ের সবাই জানে আমরা বর্গাচাষি, কাগজপত্র সব কিছুই আছে, কিন্তু সরকারি মান্ডিতে আমাদের ধান বিক্রি করার কোনও অনুমতি নেই। ওখানে আমাদের ঢুকতেই দেওয়া হয় না। তাই কম পয়সায় গাঁয়ে ধান কিনতে আসা আড়তদার, ব্যবসায়ীদের হাতে আমাদের ধান তুলে দিতে হয়।’’ ধান কেটে ট্রাক্টরে তোলার সময় এই যন্ত্রণার কথা শোনালেন বাঁকুড়া ১নং ব্লকের আঁচুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের বাদুলাড়া গ্রামের প্রবীণ বর্গাদার মাইনুল মিদ্যা।
যে যুবক ট্রাক্টর নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই জালাল-উল মিদ্যা বললেন, ‘আমরাও ভাগচাষি। কিন্তু আমাদের কেউ সরকারি মান্ডিতে ধান বিক্রি করতে পারি না। দেশ-দুনিয়ার মানুষ জানে আমরা চাষি, কিন্তু সরকারের লোকজন আমাদের চাষি হিসাবে মানতে চায় না! কী দোষ আমাদের জানি না! তাই এখন ১৮০০ টাকা কুইন্টাল দরে ফড়েদের কাছে ধান বিক্রি করতে হয় আমাদের। ফড়েরা সেই ধান মান্ডিতে নিয়ে গিয়ে ২৩২০টাকা কুইন্টাল হিসাবে দর পান। ওরা কি চাষি? কে উত্তর দেবে? কে আমাদের কথা বলবে?’ মাইনুল মিদ্যা জানালেন, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে গ্রামের বহু পরিবারের মতো তাঁরাও বর্গার জমি পেয়েছিলেন। বর্গার জমির জন্য বাবা ও পরিবারের লোকজন লড়াই করেছেন, সঙ্গে তিনিও ছিলেন, তাঁর বাবার নামে বর্গার জমি রেকর্ড হয়। সেই জমিতেই এখন চাষ করেন।
ধান কাটার মরশুমে ছোট, প্রান্তিক কৃষক, বর্গাদার, ভাগচাষিদের মুখে এখন একটাই কথা, আমাদের যন্ত্রণার কথাগুলো কোথায় জানাবো, ব্লক, পঞ্চায়েতের লোকজন জানিয়েছে, যাদের নামে জমি নেই, তাদের ধান কেনা হবে না। এটা কোনো কথা হলো? আমরা কি চাষ করি না? রবিবার বাঁকুড়া ১নং ব্লকের বাদুলাড়া, সানাবাঁধ, বৌলাড়া সহ একাধিক গ্রামের প্রান্তিক কৃষক, বর্গাদাররা তাঁদের ধান বিক্রির পরিস্থিতি এভাবেই তুলে ধরলেন। এটা খালি একটা ব্লকের তথ্য নয়, সারা জেলা থেকেই এই তথ্য উঠে আসছে। এদিন সানাবাঁধের রবি লোহার, তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি লোহারও জানালেন, তাঁরা অন্যের ১০বিঘা জমিতে চাষ করেন। চাষের পাশাপাশি খেতমজুরিও করেন। তাঁরা জানান, এই ধান ওঠার পর কিছুটা ধান বিক্রি করবেন, বাকিটা ঘরে খাওয়ার জন্য রাখবেন। কিন্তু সরকারি জায়গায় তাঁদের বিক্রি করার অনুমতি নেই।
বৌলাড়া গ্রামের কৃষক বাদল হাজারি জানালেন, ‘‘আমরা পঞ্চায়েতকে বহুবার বলেছি তোমরা তো জানো আমরা চাষি, অন্যের জমিতে চাষ করে পেট চালাই। সরকারের ঘরে ধান দিলে একটু বেশি পয়সা পাওয়া যায়। সেটা থেকে কেন আমরা বঞ্চিত হবো?’’ তিনি জানান, পঞ্চায়েতের লোকজন বলে, এর জন্য নাকি ব্লকে গিয়ে বিডিও’র কাছ থেকে লিখে নিয়ে আসতে হবে। পরপর দু’বছর গেছি, লিখে দেওয়ায় গড়িমসি করা হয়েছে। আবার স্থানীয় মেম্বাররা না বললে বিডিও লিখে দিতে চান না। কতদিন আমরা ঘরে ধানটা ফেলে রাখব? তাই বিক্রি বাইরে থেকে গাড়ি নিয়ে আসা ফড়েদের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হই।
এদিন বরুট, সানাবাঁধ, বৌলাড়া, বাদুলাড়া, কাপিষ্টা সহ একাধিক এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, জমিতে ধান কাটার কাজ চলছে, না হয় কাটার পর তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সানাবাঁধ গ্রামের ভাগচাষি মহিলা অমিতা লোহার জানান, ১০বিঘা জমিতে ভাগ চাষ করি। সব খরচ আমাকেই বহন করতে হয়। যাঁর জমি তিনি চাষ করতে পারেন না। ধান ওঠার পর বিঘা পিছু ১ হাজার টাকা লাগে জমির মালিককে। বিঘাতে ৪-৫ কুইন্টাল ধান হয়। তিনিও খেতমজুরদের সঙ্গে ধান কাটেন। তিনি জানান, বিঘাতে প্রায় ৬হাজার টাকা খরচ হয়। সেই খরচ সামলে মালিককে দিয়ে প্রায় কিছুই থাকে না ভাগচাষিদের। কিন্তু চাষটা তো ছেড়ে দিতে পারি না, তাই নেশায় চাষ করে যাই।
প্রায় একই খবর উঠে আসছে সোনামুখী, বড়জোড়া, পাত্রসায়ের, বিষ্ণুপুর, সিমলাপাল, ইন্দাস এলাকা থেকে। সেখানেও সরকারি মান্ডিতে ধান দেওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত ভাগচাষিরা। নামমাত্র দরে আড়ৎদারের কাছে ধান তুলে দিতে হচ্ছে। কারণ সারাবছর সেই আড়তদাররাই এদের সংসার চালাতে অর্থ দিয়ে যান। সার, বীজ, ওষুধ তারাই দেয়। যা দাম বলে, সেই দামেই ভাগচাষি, ক্ষুদ্র কৃষককে কিনতে হয়। ফলে ছোট, ভাগচাষি কৃষক, বর্গাদাররা পরিশ্রমের দামই পান না। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকবছর ধরে এটাই হচ্ছে এখন নিয়ম।
ভাগচাষিদের কাছ থেকে ধান না নেওয়ার কারণে সরকার যে পরিমাণ ধান নেওয়ার কথা ঘোষণা করে, তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারছে না। এদিন সানাবাঁধ, বাদুলাড়া গ্রামের একাদিক কৃষক জানান, বাঁকুড়া ১নং ব্লকের গ্রামগুলি থেকে বাঁকুড়া শহরে কৃষি দপ্তরের মান্ডিতে ধান বিক্রি করতে যেতে হয়। ব্লক এলাকায় মান্ডি হলো না। সেখানে গিয়েও আবার হয়রান হতে হচ্ছে। কোথা থেকে লক্ষ্যমাত্রা পুরণ করবে সরকার? আর বিপুলসংখ্যক বর্গাদার, ভাগচাষিরা তো বাদই থাকছে এই ব্যবস্থা থেকে।
Bargadars Crop
ধান পড়ে মাঠে, সরকারি মান্ডিতে ধান বেচার অনুমতি নেই মাইনুলদের!
×
Comments :0