CPIM SOUTH 24 PGNS

বৃহত্তর ঐক্য গড়েই রুখতে হবে দক্ষিণপন্থাকে

জেলা

সম্মেলন উদ্বোধন করে বলছেন মহম্মদ সেলিম।

অরূপ দাস: আমতলা
 বাম মনোভাবাপন্ন, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। অঞ্চলে অঞ্চলে এঁদের খুঁজে বের করতে হবে। নিচুস্তরে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলেই এসব মানুষের খোঁজ মিলবে। কারণ দক্ষিণপন্থী শক্তি কোণঠাসা করতে চাইছে বামপন্থীদের। বৃহত্তম ঐক্য গড়েই এর প্রতিরোধ করতে হবে। শুক্রবার আমতলার সোনাঝুরিতে সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ২৬তম সম্মেলন উদ্বোধন করে একথা বলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম।
জেলা সম্মেলনকে ঘিরে এলাকার নামকরণ করা হয়েছে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি নগর এবং মঞ্চের নাম হয়েছে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মঞ্চ। পার্টির রক্তপতাকা উত্তোলন করেন প্রবীণ নেতা হেমেন মজুমদার। শহীদ বেদীতে মালা, ফুল দেওয়ার পরেই শুরু হয় সম্মেলনের মূল পর্ব।
দক্ষিণপন্থার বেশি মাত্রায় মাথাচাড়া দেওয়া প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সেলিম এদিন বলেন, ‘‘বামপন্থীরা সবসময় এককভাবে এর মোকাবিলা করতে পারবে না। আর পারলেও সবাইকে নিয়েই চলতে হবে। এই চলার পথে আরও নতুন নতুন বন্ধু আসবে। পুরনোদের পাশাপাশি এই নতুন বন্ধুদের নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। নতুন বন্ধু পেলে সাহস বাড়বে। আন্দোলনও আরও বেশি দানা বাঁধবে।’’ তিনি তাঁর বক্তব্যে একারণেই বারবার অন্যান্য বাম শক্তির সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলারও আহ্বান জানান। তবে এপ্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন,‘‘পাশাপাশি পার্টিকে মজবুত করতে হবে। পার্টি শক্তিশালী হবে লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। নানা ধরনের বাধা আসবে। সেই বাধার বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে হবে পার্টিকে। আবার এই চলার পথে নানা ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি চেষ্টা হতে পারে। তাতে ভেসে গেলে চলবে না।’’ 
বস্তুত, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার কথাই উল্লেখ করেন তিনি এপ্রসঙ্গে। সেলিম বলেন, ‘‘ওই দেশে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এনিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। এতে ভেসে গেলে চলবে না। দুঃখের হলেও আমাদের বহু পার্টিকর্মী নানা প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে কখনও কখনও গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এটা মাথায় রাখতে হবে, ওদেশের সংখ্যালঘুরা যেমন আক্রান্ত হচ্ছেন, তেমন এদেশের সংখ্যালঘুরাও নিয়মিত আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। আবার অনেকের ধারণা আছে, বাংলাদেশ নিয়ে সিপিআই(এম) কিছু বলছে না। এই প্রচারে আমরাও গা ভাসালে সুবিধা পাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাই। ওরা তো এটাই চাইছে। তাছাড়া বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল আমাদের পার্টি। পরে আবার পার্টি এই নিয়ে জোরাল অবস্থান নিয়েছে।’’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘মোদী সরকারের বিদেশ নীতির জন্যই প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিতে ভারত বিদ্বেষ বাড়ছে। বিদেশ নীতি নির্ধারণের ভার বিশেষজ্ঞদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের দায়িত্ব দিলে এমনই হবে।’’
পশ্চিম এশিয়ার পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে অশান্ত করাও সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত বলে অভিযোগ করেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘‘এটাও এক ধরনের প্রকল্প। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল দখলে আসার পর এখন বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগর অঞ্চল কব্জা করার ছক চলছে। বুঝতে হবে, সেই ৬০-৭০ দশক থেকে পশ্চিম এশিয়ার প্রগতিশীল, বামমনস্ক ব্যক্তিদের কীভাবে নিকেষ করা হয়েছে। এর পিছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে কাজ করেছে। বামপন্থীদের এগুলি অনুধাবন করতে হবে। এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গণতন্ত্র ধ্বংসের প্রকল্প চলছে।’’
এপ্রসঙ্গে ভারতের কথাও টেনে আনেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘‘বামপন্থাকে নিকেশ করার জন্যই দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটানো হচ্ছে। একারণেই মাথাচাড়া দেয় ফ্যাসিস্তরা। এদেশে যেমন উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিকাশ ঘটছে। এটা একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি। ১০০ বছর ধরে এই প্রকল্প রূপায়ণের চেষ্টা চালাচ্ছে আরএসএস। আগে ছিল আস্তিনের তলায়, এখন প্রকাশ্যে এসে গেছে। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রকল্প রূপায়ণ করা হচ্ছে। ওই প্রকল্প রূপায়ণে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে হাতিয়ার হিসাবে। একারণেই জ্যোতি বসু বিজেপি নেতাদের বারবার বলতেন, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেশাবেন না।’’
এরই পাশাপাশি সম্মেলনের গুরুত্ব এবং পার্টি সংগঠন মজবুত করার কথা বলেন সেলিম। তিনি বলেন, ‘‘মতাদর্শগত চর্চার অভাব হচ্ছে। পালটে যাওয়া সময়ের বিশ্লেষণ করা জরুরি পার্টি সম্মেলনে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আজকের প্রেক্ষিতে আলোচনা করতে হবে। সমালোচনার আগে আত্মসমালোচনা করাও জরুরি। কান্নুর পার্টি কংগ্রেসের গৃহীত সিদ্ধান্ত থেকেই ফ্যাসিস্ত শক্তির বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হয় পার্টি। সেই লক্ষ্যেই ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চে শামিল হয় সিপিআই(এম)। কিন্তু একথাও রীতিমতো সভা করে বোঝাতে হয়েছে পার্টিকর্মীদের। আসলে মুখস্থ করলে হবে না, পার্টির নীতি আত্মস্থ করতে হবে। তাহলে প্রয়োগেও সঙ্কট হবে না।’’
পার্টির দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিদায়ী সম্পাদক রতন বাগচী রাজনৈতিক সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদন পেশ করে বলেন, ‘‘আগে আমরা জানতাম আমাদের দেশের প্রধান প্রধান শিল্প গড়ে তুলবে রাষ্ট্র। এরই পাশাপাশি থাকবে পুঁজিপতিরাও। কিন্তু সেই দিন বদলে গিয়েছে। এখন দেশ চালাচ্ছে ফাটকা কারবারিরাই। দেশ এখন আদানি-আম্বানিদের হাতে। এদের কথায় চলছে দেশ। দেশের সম্পদ এদের হাতে জলের দরে তুলে দিচ্ছে মোদী সরকার।’’ মোদী-মমতার যোগসাজশ বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আদানিদের নিয়ে সংসদে বিক্ষোভ হলে থাকেন না তৃণমূলের সাংসদরা। আবার এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হলেও সিবিআই-ইডি ধরে না পিসি-ভাইপোকে।’’ বাগচী অভিযোগ করেন, ‘‘কোথাও স্থায়ী চাকরি নেই। এখানে মমতা সরকার পুলিশে যেমন অস্থায়ী নিয়োগ করছে তেমনই মোদী সরকার অস্থায়ী নিয়োগ করছে সেনাবাহিনীতে। শ্রমিক সংগঠনের দর কষাকষির ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পুঁজি কুক্ষিগত হচ্ছে। মুনাফা লুটছে একচেটিয়া কারবারিরা। শ্রমের মজুত বাহিনী বাড়ছে।’’
সম্মেলনে তুষার ঘোষ, চন্দনা ভৌমিক, রুহুল আমিন গাজি, রামশঙ্কর হালদার এবং শানওয়াজ মোকামীকে নিয়ে সভাপতিমণ্ডলী গঠিত হয়েছে। শোকপ্রস্তাব পেশ করা হয়। এরই সঙ্গে পৃথকভাবে শোক জানানো হয় কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি এবং কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি। সম্মেলনে মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, কল্লোল মজুমদার, পলাশ দাশের পাশাপাশি রাজ্য কমিটির সদস্য হিসাবে উপস্থিত আছেন গার্গী চ্যাটার্জি, মীনাক্ষী মুখার্জি এবং সৃজন ভট্টাচার্য।
 

Comments :0

Login to leave a comment