Post Editorial Ganashakti 12 February

‘সৃষ্টিকর্তাকে’ নস্যাৎ করে যে লড়াই আজও চলছে

সম্পাদকীয় বিভাগ

Post Editorial Ganashakti 12 February

 

বাসব বসাক
১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রথম আত্মপ্রকাশের মুহূর্ত থেকেই যে বইটিকে ঘিরে আবিশ্ব তুমুল আলোড়ন তৈরি হয়েছিল সেটি হলো চার্লস ডারউইনের লেখা “অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস বাই মিনস্ অব ন্যাচারাল সিলেকশন অর দ্য প্রিজারভেশন অব ফেভার্ড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল্ ফর লাইফ”। আসলে চার্লস ডারউইন ১৮৩১ থেকে টানা ছ’বছর এইচএমএস বিগল জাহাজে চেপে প্রশান্ত মহাসাগর ও অতলান্তিক মহাসাগরের বুকে নানা বন্দর, পাহাড়, দ্বীপ, উপদ্বীপে ঘুরে ঘুরে যে সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর নমুনা এবং জীবাশ্ম সংগ্রহ করেছিলেন, যা কিছু প্রত্যক্ষ করেছিলেন সে সবের নিবিড় ও অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে তিনি বহু আগেই এক গভীর সত্যে উপনীত হয়েছিলেন। আর তা হলো ঈশ্বর-টিশ্বর নয় সরল জীব থেকেই ক্রমে বিবর্তনের ধারায় জটিল জীবের উদ্ভব হয়েছে, আর মানুষের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের কোনও ব্যত্যয় হয়নি। তিনি এ কথাও খুব স্পষ্ট করেই বুঝেছিলেন যে, বাইবেলে বর্ণিত নোয়ার নৌকায় যাদের ঠাঁই মিলেছিল কেবল তারাই পৃথিবীতে টিকে গেছে ব্যাপারটা ঠিক তেমনটা নয়, বরং কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে যারা খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে প্রকৃতি কেবল তাদেরকেই দিয়েছে বেঁচে থাকার ছাড়পত্র। এ সব কথা তিনি তাঁর প্রায় হাফডজন ডায়েরিতে লিখে সেগুলো বাড়ির রান্নাঘরের আলমারিতে তুলে রেখেছিলেন। কেননা তিনি বুঝেছিলেন এ সব গূঢ কথা প্রকাশ পেলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শেকড়ে বড়সড় টান পড়তে বাধ্য। কিন্তু ১৮৫৮-তে যখন তিনি জানলেন আর এক তরুণ প্রকৃতিবিদ্ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস স্বাধীনভাবে গবেষণা করে কার্যত একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তখন তিনি আর হাতগুটিয়ে বসে না থেকে, প্রথমে ওয়ালেসকে ডেকে তার সঙ্গে যৌথভাবে তাদের বিবর্তন সম্বন্ধীয় অনন্য তত্ত্বটি উপস্থাপন করলেন লন্ডনের বিদগ্ধ বিজ্ঞানীকুলের সামনে আর ঠিক তার এক বছরের মাথায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ভিত্তিতে চরমতম আঘাত লাগবে জেনেও লিখে ফেললেন যুগান্তকারী বই অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস। বইটির প্রকাশ ঘিরে ঠিক কতখানি উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে এই তথ্যে যে বইটির প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত ১২৫০ কপির সব কটিই মাত্র একদিনে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।

 

 

কেন বারবার বিবর্তন তত্ত্বের ওপর নেমে আসে আক্রমণ?
সেই প্রথম সংস্করণের একটি কপি পড়ে আপ্লুত এঙ্গেলস বন্ধু মার্কসকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, “দুনিয়ার সমস্ত কিছু, কোনও কারণ ছাড়াই বিশেষ উদ্দেশ্যে, কোন বিশেষ পরিকল্পনামাফিক সৃষ্টি হয়েছে এমন বিশ্বাসপ্রসূত যান্ত্রিক পরমকারণবাদের এই একটা দিক আজ পর্যন্ত ভাঙা সম্ভব হচ্ছিল না, যা এখন ভাঙা গেল। এর আগে কখনো প্রকৃতির ঐতিহাসিক বিবর্তনের এমন চমৎকার উপস্থাপন এবং অবশ্যই তার এমন কার্যকরী প্রভাব দেখা যায়নি”। আর ঠিক সেই কারণেই আত্মপ্রকাশের মুহূর্ত থেকেই ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব, বিশেষত প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্ব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধ্বজাধারীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। আসলে কাল্পনিক কোনও ঈশ্বরই যাবতীয় সৃষ্টির মূলে এহেন সৃষ্টিতত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব। ডারউইনের নিজের কথায়, “আমি কিছুতেই নিজেকে এই মতে আস্থাশীল করে তুলতে পারবো না যে কোনও হিতৈষী সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এই উদ্দেশ্য নিয়ে পরজীবী বোলতাদের সৃষ্টি করেছেন যাতে জীবন্ত শুঁয়োপোকার দেহের অভ্যন্তর থেকে তারা তাদের খাদ্য সংগ্রহ করে নিতে পারে”। তাঁর হবু স্ত্রী এম্মা ওয়েজুইকের কাছেও তিনি তাঁর মনোভাব গোপন না রেখে স্পষ্ট ভাষাতেই জানিয়েছিলেন যে, তিনি জীবনের ইতিহাস নতুন করে লেখার কাজে হাত দিয়েছেন, যেখানে ঈশ্বরের অসীম সৃষ্টিশীলতার কোনও জায়গা নেই। 
বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধ অবশ্য নতুন কিছু নয়। ডারউইনের জন্মেরও বহু বছর আগে আমরা দেখেছিলাম অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এই পরম সত্যটি উচ্চারণ করায় গ্যালিলিওকে চার্চ ও শাসকের কি ভয়ানক কোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। নিউটনের তত্ত্ব ঘিরেও এককালে কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞানের অমোঘ প্রমাণের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে ধর্মকে। এতকাল পরে এই সেদিন ১৯৯২ সালে এমন কি পোপকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে মৃত গ্যালিলিওর কাছে; মানতে হয়েছে তার সঙ্গে অন্যায় করেছিল চার্চ। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্বের ওপর আক্রমণ চলছেই। হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার আঙ্গিক বদলাচ্ছে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও আক্রমণ থামার কোনও লক্ষণ নেই। প্রথম দিন থেকেই দৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কার্ল মার্কসের কথায় তাঁর এই ‘যুগান্তকারী আবিষ্কার’টি হয়ে ওঠে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুরু, ধর্মীয় মৌলবাদ ও চরম দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবিন্দু। আত্মপ্রকাশের একেবারে গোড়ায় বিবর্তন তত্ত্ব গোটা ইউরোপীয় সমাজ জুড়ে যে তীব্র ঝাঁকুনি সৃষ্টি করেছিল, পরের দিকে তার রেশ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলেও বিতর্ক থেমে থাকেনি। ধর্মতাত্ত্বিক চার্লস হজ (১৮৭৪) থেকে শুরু করে ড্যুইট এল মুডি— ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধিতা সীমাবদ্ধ থেকেছে মূলত বুদ্ধিজীবী মহলেই। কিন্তু বিংশ শতকে এই বিতর্ক আর কেবল বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকল না। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন সে দেশের সাধারণ মানুষও। মনে রাখা ভালো ততদিনে বিবর্তন তত্ত্ব কার্যত একটি প্রমাণিত ও সংশয়াতীত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসাবে আবিশ্ব বিজ্ঞানী মহলের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। তবুও খোদ মার্কিন মুলুকে গত শতাব্দীর নব্বই দশকের গোড়া পর্যন্ত ডারউইনের তত্ত্ব স্কুল পাঠ্যসূচি থেকে ছেঁটে ফেলার কম চক্রান্ত হয়নি। সে সব মামলা গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। ১৯২৫ সালে উইলিয়াম ব্রায়ান নামে এক চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আমেরিকার কেন্টাকি রাজ্যের আইন পরিষদ সে রাজ্যের পাঠ্য পুস্তক থেকে ডারউইনের তত্ত্বকে বাইবেল বিরোধী তকমা দিয়ে ছেঁটে ফেললে ডেটন হাইস্কুলের জীববিদ্যার শিক্ষক জন স্কোপস্ এই সিদ্ধান্তকে সরাসরি বিজ্ঞান বিরোধী হিসাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যে মামলাটি করেন তা ইতিহাসে মাঙ্কি ট্রায়াল নামে খ্যাতিলাভ করেছিল। আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন সময় শেষ পর্যন্ত আদালতের হস্তক্ষেপেই রুখতে হয়েছে সিলেবাসে সৃষ্টিতত্ত্বের অন্তর্ভুক্তি। ২০১৯ সালের গোড়ায় আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টার প্রকাশিত একটি সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে সে দেশে যতজন মনুষ্য সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ বিবর্তনতত্ত্বকে সংশয়ের চোখে দেখে থাকে। 

 

 

 

ওই সমীক্ষা থেকে আরও জানা যায় যে আজও আমেরিকার অর্ধেক মানুষ বিবর্তনের ধারাটিকে সরাসরি নাকচ করতে না পারলেও তাকে একটি ‘ঈশ্বর’ নির্দেশিত জীবন বিকাশের ধারা হিসাবেই গণ্য করে।
আক্রমণ চলছেই
২০১৭ সালে তুরস্কে পালাবদলের পর ক্ষমতায় আসা দক্ষিণপন্থী সরকার স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে ছেঁটে দেয় ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব। একইভাবে মৌলবাদী সরকার পরিচালিত সৌদি আরব, ওমান, আলজিরিয়া, মরক্কো ইত্যাদি দেশের স্কুলপাঠ্যসুচিতে আজও ব্রাত্য ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব। মাত্র বছর পাঁচেক আগে ২০১৮ সালে আমাদের দেশের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন ডারউইন ভুল, তাই পাঠ্য বই থেকে বাদ যাওয়া উচিত ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব। এমনকি কোভিড অতিমারীর কারণে পাঠ্যসূচির ভার লাঘব করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সাম্প্রতিক অতীতে জীবনবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ছাঁটাই করে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকেই। শুধু কেন্দ্রীয় বোর্ড নয়, এ রাজ্যেও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি থেকে ছেঁটে ফেলে সেই ডারউইনকেই। অথচ কোভিডের জন্য দায়ী করোনা ভাইরাসের পশু থেকে মানব দেহে বিবর্তনের ধারাটি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে ডারউইন ছাড়া গতি নেই।

 

 
আক্রমণের নয়া আঙ্গিক
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে উন্নত ও নিখুঁত মানব উৎপন্ন করার বিকৃত ভাবনা থেকে বিজ্ঞানের মোড়কে জন্ম নেয় ইউজেনিক্স নামে এক অপবিজ্ঞানের শাখার। এই ইউজেনিক্সবাদীরা মনে করতে শুরু করে জার্মানির আর্যরাই শ্রেষ্ঠতম গুণসম্পন্ন মানব জাতি। এমনকি ১৯৩৩ সালে সে দেশে রীতিমতো আইন তৈরি করে ৩ লক্ষ ইহুদি ও অন্যান্যদের জনন ক্ষমতাই কেড়ে নেওয়া হয়। বর্তমান ভারতে যে সব কাণ্ড প্রায়শই ঘটতে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুত্ববাদীদের মুখে সর্বক্ষণ যে সব কথা শোনা যাচ্ছে তাতে ভয় হয় ভারত হয়তো বা নতুন করে ইউজেনিক্সের বধ্যভূমি হতে চলেছে। ইউজেনিক্সের মতো মানসিক বিকারকে বিজ্ঞান বলে ধরে নিলে, মানতেই হয় ডারউইনের তত্ত্ব ভুল। কিন্তু সাম্প্রতিক জিনোম পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে মানুষের জিনের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হওয়ায় ইউজেনিক্সওয়ালাদের বিশুদ্ধ আর্য জিনের ফক্কিকারি মাঠে মারা গেছে। বরং আজ এ কথা সবাই জানে শিম্পাঞ্জির সঙ্গে আধুনিক মানুষের জিনের মিল ৯৮ শতাংশেরও বেশি। যার অর্থ শিম্পাঞ্জি ও মানুষ কোনও এক সাধারণ জ্ঞাতি থেকেই উদ্ভূত হয়ে থাকবে। অর্থাৎ ডারউইন সাহেবকে ফুল মার্কস দিতেই হবে আপনাকে। হলে কি হবে! ডারউইনের তত্ত্বের অপব্যাখ্যাও আর এক রকম চক্রান্ত। কেউ কেউ তাই ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের অন্যতম মূল কথা যোগ্যতমের ঊর্ব্েতনকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে, সামাজিক ডারউইনবাদ নামক কাঁঠালের আমসত্ত্ব জাতীয় এক আজগুবি তত্ত্বের আড়ালে ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে শ্রেণি শোষণ অথবা উন্নততর জাতির অস্তিত্বের অলীক ধারণাকে বৈধতা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো ডারউইন প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন তাঁর তত্ত্ব। মানুষের সমাজে তা কি করে প্রযোজ্য হতে পারে? মানুষের সমাজের যাবতীয় রোগের মূলে যে অসাম্য ও তার কারণগুলি দূর না করা গেলে যোগ্যতার পরিমাপ হবে কীভাবে? আদানি আর একজন কাজ হারানো ঠিকে শ্রমিকের অবস্থান কি একই বিন্দুতে, যে আমরা এদের মধ্যে যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন অনুসন্ধান করব? 
বৌদ্ধিক নকশা: ডারউইনের তত্ত্বকে নস্যাৎ করার নয়া অপকৌশল
গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আমেরিকার সিয়াটেলস্থিত ডিসকভারি ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা হলো বৌদ্ধিক নকশার তত্ত্ব বা ইনটেলিজেন্ট ডিজাইনের অবৈজ্ঞানিক এক ধারণাকে। আবারও বিদ্যালয় পাঠ্যসূচিতে এই অদ্ভুত মতবাদের অন্তর্ভুক্তির দাবি উঠল আমেরিকায়। এই বৌদ্ধিক নকশাতত্ত্বের পৃষ্ঠপোষকদের বক্তব্য জীবদেহের এহেন জটিল নকশার পিছনে মানুষের থেকেও বুদ্ধিমান কারো হাত না থেকে যায় না। তার মানে নতুন বোতলে সৃষ্টিতত্ত্বের সেই পুরানো মদ পরিবেশনের প্রাণান্ত প্রয়াস। তারা ডারউইনের তত্ত্বকে খারিজ করে দেওয়ার বাসনায় প্রশ্ন তুলে দিলেন এই যে মেরুদণ্ডী প্রাণীর চোখের গঠনে এত জটিলতা সে কি ধাপে ধাপে অর্জন করা সম্ভব? ডিসকভারি ইনস্টিটিউটের মুখপাত্র ক্যাসে লুসকিন বললেন নিশ্চিতভাবেই এই জটিলতা ধাপে ধাপে অর্জিত হয়নি, বরং কোনও এক অতিলৌকিক বুদ্ধিমান এহেন জটিল গঠনের নকশা বানিয়েছে। যদিও ক্যালিফোর্নিয়ার অক্সিডন্টাল কলেজের প্রত্নতত্ত্ববিদ ডন প্রোথেরো লুসকিনের প্রশ্নের জবাবে ২০০৪ সালেই প্রমাণ করে দেন যে, বিভিন্ন সময়কালে প্রাপ্ত জীবাশ্ম থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে মেরুদণ্ডী প্রাণীর চোখের বিবর্তন ঘটেছে ধাপে ধাপেই। একইভাবে খুব সম্প্রতি প্রশ্ন তোলা হয়েছে মানব মন এবং তার গতি প্রকৃতি, সে কি ডারউইনের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? ইয়েল ইউনিভার্সিটির স্নায়ুতত্ত্ববিদ্ স্টিভেন নোভেল্লা এই প্রশ্নকে নস্যাৎ করে দেখালেন কিভাবে মস্তিষ্কের গাঠনিক পরিবর্তনের সঙ্গেই মন এবং চিন্তার পরিবর্তন ঘটে থাকে এমারাই-এর মত অত্যাধুনিক পদ্ধতির সাহায্যে এ কথা প্রমাণ করা খুবই সহজ যে মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তনের কারণেই মনের ভাবসাবের বদল ঘটে থাকে। তার মানে ডারউইন বিরোধীরা আবারও ডাহা ফেল করলেন।

 

 

 
সাভান্তে পাবোর নোবেল জয় : ডারউইন বিরোধীদের কফিনে শেষ পেরেক
গত বছর চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডিশ বিজ্ঞানী সাভান্তে প্যাবো। তিনি নতুনতর প্রযুক্তির সাহায্যে বহু যুগ আগের নিয়েন্ডারথাল মানব ও ডেনিসোভান মানবের জীবাশ্ম খণ্ড থেকে ডিএনএ-র অংশ নিষ্কাশন করে এক অসাধ্য সাধন করে ফেলেছেন। ওই দুই প্রজাতির মানবের জিন বিশ্লেষণ করে আধুনিক মানুষের জিন সজ্জার সঙ্গে তার তুলনা করে তিনি দেখিয়েছেন আধুনিক মানবের সঙ্গে এক সময় নিয়েন্ডারথালদের এবং ডেনিসোভানদের প্রজনন অবশ্যই ঘটেছিল, কেননা আধুনিক মানবের জিনোমে ওই দুই প্রজাতির জিনের সংমিশ্রণের প্রমাণ মিলেছে। শুধু তাই নয় নিয়েন্ডারথাল জিন যে সব আধুনিক মানবের মধ্যে কিছুটা বেশি তারাই কোভিডের সংক্রমণে কাতর হয়েছে বেশি। আবার আফ্রিকার আজকের মানবের মধ্যে নিয়েন্ডারথাল জিন সেইভাবে না পাওয়া যাওয়ায় প্রমাণ হয়েছে ভারত বা অন্য কোথাও নয়, আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকাতেই। সেখান থেকেই তারা ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ, মধ্য এশিয়া হয়ে সারা দুনিয়ায়। আর এই ছড়িয়ে পড়ার পথে কোথাও নিয়েন্ডারথাল, কোথাও বা ডেনিসোভানদের দেখা পেয়েছে সে; আত্মীয়তা হয়েছে অনেকাংশে একই রকম দেখতে অন্যান্য মানব প্রজাতির সঙ্গে; প্রজননে লিপ্ত হয়েছে তারা আর তারপর জন্ম নেওয়া শিশুদের কোলে কাঁখে নিয়ে হোমো স্যাপিয়েন্সরা দল বেঁধে এগিয়ে গেছে দূরদেশে। এ ভাবেই এই পৃথিবীতে টিকে থাকার ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছে তারা। পক্ষান্তরে নিয়েন্ডারথালের মতো অন্য প্রজাতিকুল জিনগত বৈচিত্রের অভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পরীক্ষায় ফেল ক’রে হারিয়ে গেছে দুনিয়া থেকে। তার অর্থ দাঁড়ালো জিনগত বিশুদ্ধতা, আর্য রক্তের দম্ভ – এসব একেবারে ফালতু ব্যাপার; যেমন ফালতু ব্যাপার ইনটেলিজেন্ট ডিজাইনের উদ্ভট তত্ত্বটিও। প্যাবোর এই আবিষ্কার, সন্দেহ নেই যাবতীয় সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বটিকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের শক্ত ভিতের ওপর নতুন করে দাঁড় করালো।

 

   

২০১১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিনিধি (অধুনা প্রয়াত) পিট স্টার্ক মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাব আনেন ‘বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রতীক হিসাবে এবং তাকে কেন্দ্র করে আবিশ্ব বিজ্ঞান ও মানবতার জয় উদ্‌যাপনের উদ্দেশ্যে’ ডারউইনের জন্মদিন ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখটি পালিত হোক ডারউইন দিবস হিসাবে। সেই থেকেই ডারউইন দিবস পালিত হয়ে আসছে দেশে দেশে। তাই ১২ ফেব্রুয়ারি হোক শপথ নেওয়ার দিন। যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস, অপবিজ্ঞান ও কূপমণ্ডূকতার বিপ্রতীপে বিজ্ঞান চেতনার চিরাগ জ্বালানোর দিন হোক ১২ ফেব্রুয়ারি।

Comments :0

Login to leave a comment