এবার কাঁওয়ার যাত্রার পথের ধারে মসজিদ এবং মাজারের সামনে পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো! শুক্রবার উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে এই ঘটনা ঘটেছে। এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ায়, সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে থাকায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরে পর্দা সরিয়ে দেওয়া হয়। এদিনই সুপ্রিম কোর্টে কাঁওয়ার যাত্রার পথে খাবারের দোকানে দোকানির নাম লেখা নিয়ে উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড সরকারের সিদ্ধান্তের শুনানি ছিল। সুপ্রিম কোর্ট এদিন ফের সেই নির্দেশের উপরে স্থগিতাদেশের বজায় থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে মধ্য প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড সরকারের জবাব তলব করেছে সর্বোচ্চ আদালত। এদিকে, যাত্রাপথে কাঁওয়ারি বা শিবভক্তদের উপদ্রব অব্যাহত আছে। এর আগে একাধিক জায়গায় তারা মারধর, ভাঙচুর করেছে। এদিনও মীরাটে একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। গাড়ির বাসিন্দা চার জনই মুসলিম ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক জনকে ধরে মারধর করে জামাকাপড় ছিড়ে দেয় পুলিশের সামনেই।
এদিন সকাল থেকেই দেখা যায় হরিদ্বারের রামনগর এলাকায় কাঁওয়ারিয়াদের যাত্রা পথের ধারে মসজিদ এবং মাজারের সামনে সাদা পর্দা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বোয়ালাপুরেও একটি মসজিদের সামনে একই ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের নির্দেশেই এই পর্দা টাঙানো হয়েছে বলে জানা যায়। মসজিদ এবং মাজার পরিচালন কমিটির পক্ষ থেকেও এই কথাই বলা হয়। ‘সমস্যা এড়াতেই’ প্রশাসন এই বন্দোবস্ত করেছিল। কিন্তু বিতর্ক শুরু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত বিকেলে পর্দা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় উত্তরাখণ্ডের বিজেপি প্রশাসন। মসজিদের মৌলনা এবং মাজারগুলির কেয়ারটেকাররা জানিয়েছেন, প্রশাসনের তরফ থেকে তাদের এই বিষয়ে আগে কিছুই জানানো হয়নি। তাঁরা বলেছেন, এতদিন ধরে কাঁওয়ার যাত্রার সময়ে কোনও সমস্যাই হয়নি। এই প্রথম এই ধরনের কোনও পদক্ষেপ করা হলো। স্থানীয়রা প্রতিবাদ জানালে এবং রাজনৈতিক নেতারাও এইভাবে মসজিদ, মাজার ঢেকে দেওয়া নিয়ে আপত্তি জানালে প্রশাসন সন্ধ্যার মধ্যে পর্দা সরিয়ে নেয়।
হরিদ্বারের পুলিশ সুপার ও জেলাশাসক এই নিয়ে এদিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সতপাল মহারাজ বলেছেন, এই ধরনের যে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বা কাজ করা হচ্ছে, সবই ‘সমস্যা এড়ানো’র জন্য। মন্ত্রী আরও বলেছেন, এটা এমন কোনও বড় বিষয় নয়। ভবন নির্মাণের সময়েও তা পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যাত্রা পরিচালনার জন্য নিযুক্ত বিশেষ পুলিশ অফিসার দানিশ আলি এদিন বিকেলে পর্দা খুলে নেওয়ার সময়ে জানান, আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পর্দা খুলে ফেলার জন্য, তাই খুলে নেওয়া হচ্ছে। প্রাক্তন মন্ত্রী কংগ্রেস নেতা নঈম কুরেশি এদিন এই প্রসঙ্গে বলেছেন, হরিদ্বারের মুসলিমরা সবসময়েই শিবভক্তদের স্বাগত জানিয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় মুসলিমরাই কাঁওয়ার মেলা এবং পদযাত্রীদের জন্য জল, শরবত, খাবারের বন্দোবস্ত করে। শিবভক্ত পদযাত্রীরা তা সাদরে গ্রহণ করেন। কোনোদিন এই নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। হরিদ্বারে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে চিরকাল এই সদ্ভাব, ঐক্য ছিল। এখানে কোনোদিন এইভাবে পর্দা টাঙিয়ে দিয়ে বিভাজন তৈরির সংস্কৃতি ছিল না। কাঁওয়ার মেলার আগে উভয় সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে সভা করা হতো।
পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া একটি মাজারের কেয়ারটেকার শাকিল আহমেদ বললেন, প্রতিবারই মসজিদ-মাজারের প্রাঙ্গণের গাছের ছায়ায় ক্লান্ত পদযাত্রীরা বিশ্রাম নেন। এবারেই প্রথম এই ধরনের ঘটনা ঘটলো। মাজার কর্তৃপক্ষকেও পুলিশ বা প্রশাসনের থেকে আগাম জানানো হয়নি যে, এইভাবে তা পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। স্থানীয়রা এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত বোধ করেছেন। অনেকেই জানিয়েছেন, এমন ঘটনা আগে কখনও হয়নি। মসজিদ-মাজারের সামনে দিয়ে কাঁওয়ারিয়ারা গেছেন বলে তো কোনোদিন কোনও অশান্তি হয়নি। উলটে অনেক শিবভক্ত পদযাত্রী তো মাজারেও যান। সেখানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ভারতের বিভিন্ন অংশেই হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই পীরের মাজারে যান।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টে এদিনও উত্তর প্রদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সওয়াল করা হয় তাদের সিদ্ধান্তের পক্ষে। উত্তর প্রদেশ সরকার সুপ্রিম কোর্টেও সেই একই যুক্তি হাজির করে বলেছে, ‘সমস্যা এড়াতেই’ খাবারের দোকানের মালিক এবং কর্মচারীদের নাম লিখে দিতে বলা হয়েছিল। কাঁওয়ার তীর্থযাত্রা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হয়, সে কারণেই ওই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল এবং তা সঙ্গত কারণে বলেই এদিনও আদালতে সওয়াল করেছেন উত্তর প্রদেশ সরকারের আইনজীবী। উল্লেখ্য, ২২ জুলাই সোমবার কাঁওয়ার যাত্রার শুরু দিনেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হৃষীকেশ রায় ও বিচারপতি এসভিএন ভাট্টির বেঞ্চ স্থগিতাদেশ জারি করেছিল উত্তর প্রদেশ সরকারের ওই নির্দেশিকার উপর। শীর্ষ আদালত জানায়, কাঁওয়ার যাত্রার পথে দোকানদারদের নাম দোকানের বোর্ডে লিখতে বাধ্য করা যাবে না। একই সঙ্গে শুক্রবারের মধ্যে সরকারের তরফে ব্যাখ্যাও চেয়েছিল শীর্ষ আদালত। কিন্তু উত্তরাখণ্ড এবং মধ্য প্রদেশ সরকার এই মর্মে কিছু না জানানোও তাদের জবাবও তলব করেছে সর্বোচ্চ আদালত। দুই বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়েছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী শুনানি হবে এই নিয়ে। ততদিন এই স্থগিতাদেশ বজায় থাকবে। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিলেও যদিও উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডে ইতিমধ্যেই দোকানিরা নাম লিখে দোকানে টাঙিয়ে দিয়েছেন। এমনকি ঠেলাতে করে ফল বিক্রেতাও কাগজে নাম লিখে ঠেলার গায়ে সিঁটিয়ে রেখেছেন। তাঁদের বক্তব্য, ঝামেলায় গিয়ে লাভ নেই।। নাম লেখা না থাকলে মারধর এবং সামগ্রী নষ্ট করে দেওয়ার আশঙ্কা থাকছেই।
Comments :0