গল্প
সংস্কার
সৌরভ দত্ত
মুক্তধারা
ছ-নম্বর পাঁঠাটা বলি করার পর পৈশাচিক উল্লাস উঠল একটা।ব্যাঁ-ব্যাঁ করে শব্দ টা মিলিয়ে গেল অচিরেই।অন্তা কামারের কোমরে ধুতিতে জড়ানো গামছাটায় একটা সজোরে বাঁধন দিল।একটু আগে কেল্টু পাঁঠাটাকে সোহাগ করে কাঁঠাল পাতা খাওয়াচ্ছিল।পরম সুখে কচি কাঁঠালপাতা চিবুচ্ছিল পাঁঠাটা।তারপর কিছুক্ষণ পরেই হাঁড়িকাঠে মাথা চলে গেল।ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা।হাঁড়ি কাঠ থেকে গড়িয়ে নামছে রক্তের ফল্গুধারা।কিছু চাপ চাপ রক্ত মাটিতে ছিটকে পড়ে আছে।তা থেকে কিছু নিয়ে মাটির সরায় করে দেবীর উদ্দেশ্য নিবেদিত হল। কুমারী পুজো চলছে।ও পাড়ার পিন্টু তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে কামারের থেকে পাঁঠার মাথাটা কেড়ে নেবে বলে।এত বড় পাঁঠার গলায় কোপ মারার পর কামার হাঁপাচ্ছে।ঐ মাথাটা দিয়েই জমিয়ে রান্না হবে রাতে আসর জমবে।চক্রবর্তী বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই বেশ রাজকীয় ব্যাপার। কলকাতা থেকে শহুরে বাবুরা গাড়ি করে এসেছে গাঁয়ের পুজো দেখতে। ধোপদুরস্ত ধূতি পাঞ্জাবি পড়ে নাটমন্দিরের সামনে গালগল্পে মেতেছে।কিন্তু সন্ধ্যায় সন্ধি পুজোর বালিটা কেল্টুর সারা দেহে শিহরণ তুলেছে।ওর ইচ্ছে করে– কামারের হাত থেকে ভয়ংকর ওই খাঁড়াটা কেড়ে নিতে।
মনের মধ্যে কত ইচ্ছে বীজ।সব বন্ধুরা মিলে বাজি পোড়াবে। চন্দননগরের আলোকসজ্জা দেখতে গ্রাম থেকে একদল ম্যাটাডোর করে পাড়ি দিয়েছে।সেও যাবে ভেবেছিল।পৃথিবীর বিখ্যাত আলোর কাজ।কেল্টু ভাবে মশাল জ্বালিয়ে ঠাকুর নদীতে চলে যাবে।ড্যামকুড় কুড় বাদ্যি বাজবে।কত পূর্ব পরিকল্পিত ভাবনা ছিল। উঠোনে বুড়ি বসন্ত খেলবে। রঙিন কাগজ কেটে শিকলি বানাবে। নাটমন্দিরের আনাচকানাচে লুকোচুরি হবে।একসময় এখানের রকে পাঁচালি গানের আসর বসত। দাশুরথি রায়ের পাঁচালি পরিবেশন করতেন রতন রায়।এখন সে পাট চুকেছে।তখন নাটমন্দিরের নবনির্মাণ হয়নি। ইলেকট্রিক ঢাক আসেনি।ভাঙা দালানে হ্যাজাক জ্বালিয়ে পুজো হত।আশপাশের গ্রামের চারিদিক থেকে মানুষজন আসত তৃপ্তি করে খিচুড়ি ভোগ খেতে।এখন আর আসে না ।পুরোটাই পারিবারিক পুজো।ফটোসেশন বা মায়ের মুখ ক্যামেরাবন্দি করার প্রতিযোগিতা চলে। দুপুরে এক কিলোমিটার রাস্তা ভিজেজামাকাপড়ে দণ্ডি কেটেছে কাল্টুর মায়েরা। পাঁঠা বলি,দণ্ডিকাটা ঠাকুরের নামে এসব আচার বিচারে তার মন সায় দিতে চায় না। সেজন্য বিকালে সন্ধি পুজোয় অঞ্জলি দিতে দিতে মনটা উদাস হয়ে যায়। দুদিনের পুজো কাটলেই ফের জীবনের জটিল ঐকিক নিয়মে বন্দি।একটু পরে মিউজিক্যাল চেয়ার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে।
কেল্টু দেখে এসেছে পাশের বেজ বাড়ির পাঁঠাকোপ বন্ধ করে দিয়েছে পরিবারের লোকজন। বিকল্প প্রতীকী হিসেবে আখ, চালকুমড়া বলি হয়।কেল্টু ভাবছে ভবাণী চক্রবর্তীকে বলবে– জ্যেঠু আমাদের পুজোতেও কি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কিন্তু বলতে পারছে না।বললেও কি সকলে ব্যাপারটাকে সহজে নেবে! এতদিনকার চলে আসা প্রথা ভাঙতে কি কেউ এত সহজে রাজি হবে।দেবীর যদি পুজোর খুঁত হয় এই দোহাই দেবে বড়রা।
এমন সময় মাথায় একটা বুদ্ধি এল কেল্টুর। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরুর তোড়জোড় হচ্ছে। এমন সময় রাজাদার হাত থেকে মাইকটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে কেল্টু ঘোষণা করল আমরা অনুষ্ঠান শুরু করব ,খেলাও হবে। কিন্তু তার আগে একটা প্রস্তাব সকলকে দিচ্ছি– আপনারা সকলে ভেবে দেখবেন –আমরাও যদি ও পাড়ার বেজ বাড়ির মতো পাঁঠাকোপ বন্ধ করে দিই তাহলে কেমন হয়? এই ঘোষণা শুনে ছুটকি দৌড়ে এল ।বলল–ঠিক বলেছিস কেল্টুদা।পুজো হোক ,ঢাক বাজুক, মশাল জ্বলুক কিন্তু পাঁঠা বলি বন্ধ হোক।পুজো এলেই বেচারা পাঁঠা গুলো কাটা পড়ে।আস্তে আস্তে বাড়ির সকলে জড়ো হল নাটমন্দিরের সামনে গোল হয়ে সবাই দাঁড়িয়ে।কেল্টুর কথার অভিঘাতে নড়ে গেছে ভবাণী চক্রবর্তীর দীর্ঘদিনের সংস্কার।তিনি মাইক হাতে পরের বছর থেকে পরিবারের সকলের সামনে প্রকাশ্যে পাঁঠাবলি বন্ধের ঘোষণা করলেন।
মিউজিক্যাল চেয়ার শুরু হল,শেষ হল। বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠল ।গাঁয়ের লুপ্তপ্রায় মিষ্টি শৈল ময়রার খইচুর বিলি হল।ছুটকি আর কেল্টু দুজনে মিলে একটা ফানুসে আগুন জ্বালিয়ে–জাস্টিস ফর আর.জি কর লিখে হুস্ করে ছেড়ে দিল।হালকা হাওয়ায় ফানুস উড়ে যাচ্ছে গাছগাছালির ঝাঁক ক্রমশ উঁচুতে স্কুলের ছাদ টপকে চাঁদের কাছাকাছি। হলুদ শিখা দপদপ করে জ্বলছে।কেল্টুরা দূর আকাশে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেরাই ক্রমশ একটা ফুটকি হয়ে যাচ্ছে …ঠাকুর চলেছে বিসর্জনে…রাস্তায় সবার হাতে মশাল জ্বলছে…
Comments :0