সুদীপ্ত বসু: ভাঙড়
সায়েন্স সিটি থেকে দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার।
এই শহরের অদূরেই, কলকাতা পুলিশের এলাকাতেই জমি হাঙরদের দাপাদাপি, জমি লুটের যে ভয়াবহ চেহারা সামনে আসছে তা রীতিমত শিউরে ওঠার মতো।
গোটা ভাঙড় নয়, কেবলমাত্র একটি ব্লকের একটি পঞ্চায়েত এলাকাতেই ইতিমধ্যে ৫০১ একরের বেশি জমি বেবাক বেহাত হয়ে গেছে। তারমধ্যে আছে রামসার সাইটের জলাভূমি, পাট্টার জমি, রায়ত জমি, সরকারি খাস জমিও। এখনও পর্যন্ত মোট পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমি। জমি হারাতে বাধ্য হওয়া সিংহভাগই আদিবাসী।
এখানেই শেষ নয়, জমি হাঙরদের এই জমি লুটের কারবারে ভাগ পেয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ভাইও! এখানেই কোভিডের সময় আন্দুলগেড়ি মৌজায় ‘জমির মালিক’ বনে গেছেন কার্তিক ব্যানার্জি।
এখানেও আছে ‘শাহজাহান’। পুরো নাম শাহজাহান মোল্লা, ভাঙড়-১নম্বর তৃণমূলের সভাপতি, মূলত জমি মাফিয়া। আছে একাধারে তৃণমূল ও জমির দালাল গৌতম মণ্ডল, রাকেশ রায়চৌধুরি। সওকত মোল্লার ডান হাত। আর সওকত মোল্লা কিংবা ফলতার জাহাঙ্গির খান’রা কার ডানহাত জানে গোটা রাজ্য! ভাইপো সাংসদের অনুগামী বলেই নিজেদের পরিচয় দেয় এই বাহিনী।
হঠাৎ করে কেন এখানেই, লেদার কমপ্লেক্স থেকে তিন কিলোমিটার দূরে এই জায়গাগুলোই নজরে পড়লো জমি হাঙরদের? সেই রহস্য জানার আগে এসে দাঁড়ানো যাক তাড়দহে। জমি লুটের বিবরণ এই জমিদারি আমলের লেঠেল বাহিনীকেও লজ্জায় ফেলে দেবে।
প্রায় ষাটের ঘরে পৌছানো কালীপদ মণ্ডল একটি চোখে এখনও ঝাপসা দেখেন। দু’-দু’বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। কেন? তাড়দহের বাসিন্দা কালীপদ মণ্ডল এদিন দুপুরে ভরা রোদে দাঁড়িয়ে বেহাত হওয়া জমির দিকে তাকিয়েই শোনাচ্ছিলেন সেই কাহিনি। ঝাউখালিতে তাঁর এবং দাদার মোট চার বিঘা জমি। সেখানে মাছ চাষ করতেন। সেই জমিতেও নজর পড়ে তৃণমূলের তৃণমূলের তাড়দহ অঞ্চলের নেতা, জমির দালাল হিসাবেই পরিচিত গৌতম মণ্ডলের। জমি দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁর এক ছেলেকে বেধড়ক মারধর করা হয়। মাথায় ছটি সেলাই পড়ে। তারপরেও ফের কাঁটাতলায় গৌতম মণ্ডলের অফিসে ডেকে পাঠানো হয় কালীপদ মণ্ডলকে। পার্টি অফিসে ডেকে নিয়ে এসে বলা হয়, জমি দিতেই হবে। কিছু টাকা আমরা দিয়ে দেবো। ‘আমি না বলতেই এলোপাথাড়ি মারধর করা হয়। চেয়ার থেকে ফেলে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরেই পেটানো হয়। ছেলেও মারধর করা হয়। তখনই একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। রক্ত পড়তে থাকে তার মধ্যেই আমাকে সই করতে বাধ্য করা হয়। আমি তবুও করিনি।’ বলছিলেন কালীপদ মণ্ডল।
তাতেও রেহাই নেই। এরপর আরেক তৃণমূলী মাফিয়া, এলাকার ত্রাস শাহজাহান মোল্লার তার অফিসে তলব করে। সেখানেও চলে হুমকি, শেষ পর্যন্ত ঝাউখালিতে ১৫২৮ দাগের চারবিঘা জমি হাতছাড়া হয়। জোর করে মাত্র লাখ খানেক টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। যা বাজার মূল্যের দশভাগেরও একভাগ নয় ।
অসহায় কালীপদ মণ্ডল বলছিলেন— ছুটে যাই কেএলসি থানায়। ওরা বলল আপনি গৌতম মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলে মিটমাট করে নিন। পুলিশি, ভূমি দপ্তর সব যুক্ত। না হলে জমির কাগজ, রেকর্ড এখনও আমার নামে। অথচ জমির দখল ওদের কাছে। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আকমোক্তারনামা ওরা করে নিয়েছে নিজেদের নামে। আমার নামে রেকর্ড সেই জমি দখল করে অন্য কয়েকজনকের কাছে বিপুল টাকায় বিক্রিও করে দিয়েছে শুনলাম। ভোট দেওয়ার তো অধিকার নেই গত দশ বছর ধরে সওকত বাহিনীর তাণ্ডবে। এখানে গ্রামের পর গ্রামের মানুষ এখানে নিজেদের জমিও হারাচ্ছে’।
কেন তৃণমূলের নেতারা উন্মত্তের মতো বিঘার পর বিঘা জমি দখল করতে নেমেছে? ২০১৫ সালে মমতা ব্যানার্জির মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত, সেক্টর ফাইভের মতো সেক্টর সিক্স (বানতলা) ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ গড়ে তোলা হবে। ২০২১ সালের ১০ ফেব্রয়ারি কমিটির মিটিং থেকে পরিকাঠামো উন্নয়নের সিদ্ধান্ত হয়, কমিটির চেয়ারম্যান মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সেই মেগা সিটির আওতায় এই তাঐড়দহ পঞ্চায়েতের তাড়দহ কাপাসআটি মৌজা, আন্দুলগেড়ি, ভাটিপোতা, কড়াইডাঙার মতো গ্রামের জমিও স্বাভাবিকভাবে সরকার অধিগ্রহণ করবে। আর তার আগে এই বিস্তীর্ণ তল্লাটের ৮০ শতাংশের মতো জমি শওকত-শাহজাহানদের বাহিনী হিসাবে গৌতম-রাকেশরা দখল করতে নেমেছে। পরে যা কয়েকগুণ বেশি দামে বেচা হবে সরকারের কাছেই। প্রশাসনের শীর্ষ মহলের ইন্ধন ছাড়া তা সম্ভব?
অন্ধ্র প্রদেশের নতুন রাজধানী অমরাবতী গড়ে তোলার সময় সরকারি মদতেই একইভাবে জমি দালালদের মাধ্যমে কৃষকদের ঠকিয়ে জমি হাতানো হয়েছিল, যা পরে বিপুল দামে সরকারের কাছেই বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছিল। সেই জমি কেলেঙ্কারিতেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু ও তাঁর মন্ত্রীসভার একাধিক সদস্য অভিযুক্ত হন।
অমরাবতীর মডেল এবার ভাঙড়েও!
একদিকে গৌতম মণ্ডল, অন্যদিকে তৃণমূলের এই তারদহ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান রাকেশ রায় চৌধুরি। কালীপদ মণ্ডলের কথায়, বছর দুয়েক আগেও এদের অফিসে ঐ কালীঘাটের কাকুকে আসতে দেখতাম। কলকাতার বাবুদের কাছেও এখানে বেনামে সব জমি তুলে দিচ্ছে’। কালীপদ মণ্ডলের স্ত্রী স্বর্ণবালা মণ্ডলের নামে এখনও রেকর্ড রয়েছে। খতিয়ান নম্বর ৪৭৮৯। অথচ জমি দখল করে তা এক দফায় বেচাও হয়ে গেছে গৌতম মণ্ডলের বাহিনীর।
১৫২৮ দাগ নম্বরেই তাড়দহ পঞ্চায়েতের ঝাউখালিতে মোট সাড়ে নয় একর অর্থাৎ ৩৮ বিঘা এই সময়কালে দখল করেছে তৃণমূলী বাহিনী। পুরোটাই জলাশয়। পূর্ব কলকাতা জলাভূমির অন্তর্গত। রামসার সাইট হিসাবে চিহ্নিত। আদিবাসীদের জমি যেমন হস্তান্তর করা যায়না তেমনি রামসার সাইটে কোনও নির্মাণও করা যায় না। অথচ সেখানেই দখল করে পাঁচিল তুলে দেওয়া হচ্ছে। শুধু এই দাগ নম্বরেই ১৮জন কৃষকের জমি চলে গিয়েছে তৃণমূলী জমি হাঙরদের দখলে।
পাশেই ১৪৬৫ দাগ নম্বরের জমি। তারদহ কাপাসআটি মৌজায় এই দাগ নম্বরের ৮৬.৯ একর অর্থাৎ প্রায় ২৫৮বিঘা জমি তৃণমূলী জমির দালালরা দখল করেছে। প্রায় ১৫০ জন কৃষককে জমি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। এর মধ্যে পাট্টাদাররা আছে, ৪৫ জন আদিবাসীও জমিছাড়া হয়েছেন। যেমন অলক মুন্ডা। মাছ চাষ করেই সংসার চালাতেন। বলছিলেন— আমার দু’বিঘা জমি নিয়ে নিলো। রাতের বেলায় কেএলসি থানা থেকে পুলিশ এসে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে পুলিশ এই গৌতম-রাকেশদের কাছে জমি ছেড়ে দিতে হুমকি দেয়। কী করবো আমরা? বিজলী মুণ্ডা যেমন বললেন— আমার আড়াই বিঘা জমি নিয়েছে। আজও আমি টাকা নিইনি। আমার নামে কাগজ, ওরা দখল করে পাঁচিল তুলে দিচ্ছে। ওরা সরকারে, ওরা সব পারে! পাশের দাগ নম্বর ১৩১৩। এখানে ১৮৩.৮৭ একর জমি সম্পূর্ণ দখল করে নিয়েছে রাকেশ-গৌতমের বাহিনী।
নগরায়নের সরকারি পরিকল্পনা জেনে আগাম জমি দখল করে তা সরকারের কাছেই বহুগুণ বেশি দামে বেচার শাসক দলের ব্যবসার নতুন মডেল!
Comments :0