রেশন বণ্টন দুর্নীতির টাকা ঘুরপথে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মাধ্যমে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ হয়েছে। মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তে এবার সামনে এল এমনই তথ্য।
এর আগে একইভাবে নিয়োগ দুর্নীতিতে রিয়েল এস্টেটের টাকা ঘুরপথে কালীঘাটের কাকুর নিজস্ব সংস্থার মাধ্যমে অভিষেক ব্যানার্জির কোম্পানি লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে ঢুকেছিল। রিয়েল এস্টেটে খেটেছিল নিয়োগ দুর্নীতির টাকা। একটি বড় রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কাছে ভুয়ো বিল জমা দিয়ে, কার্যত খাতায় কলমে লেনদেন দেখিয়ে ৯৫ লক্ষ টাকা মুনাফা করেছিল সুজয় ভদ্রের সংস্থা এসডি কনসালটেন্সি। কোনরকম বিনিয়োগ ব্যবসা ছাড়াই টাকা ঢুকেছে তাঁর সংস্থায়। গোটা কারাবারটি শুধু খাতায় কলমে দেখানো হয়েছিল। বানানো হয়েছিল ভুয়ো বিল। এরপরে কালীঘাটের কাকুর সেই সংস্থার মাধ্যমেই ২০২০সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২১’র জানুয়ারি পর্যন্ত তিন দফায় মোট ৯৫ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে।
এবার রেশন দুর্নীতিকাণ্ডেও সামনে এল রিয়েল এস্টেটের কারবার। রেশনের বরাদ্দ চাল, গম খোলাবাজারে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির চক্র বাকিবুর রহমানের হাত ধরে প্রকাশ্যে এসেছে। এই মামলাতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালু। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, রেশন দুর্নীতি টাকা অন্যত্র সরানোর জন্য একাধিক ভুয়ো, শিখণ্ডী সংস্থাকে ব্যবহার করেছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ইতিমধ্যে সামনে এসেছে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তাঁর স্ত্রী, কন্যা, এমনকী বাড়ির পরিচারককে তিনটি ভুয়ো সংস্থার ডিরেক্টর বানিয়ে সেই কোম্পানির মাধ্যমে রেশনের চাল, আটা খোলাবাজারে বিক্রির বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সাদা করেছেন।
এবার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করতে অনুব্রত মণ্ডল, মানিক ভট্টাচার্যের মতো বালুও পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার করেছেন।
আরওসি’র তালিকায় দেখা যাচ্ছে রেশনকাণ্ডে ধৃত মন্ত্রীর স্ত্রী মণিদীপা মল্লিক আরও চারটি সংস্থার বোর্ড অব ডিরেক্টরসের রয়েছে। চারটি সংস্থাই রিয়েল এস্টেট কারবারের সঙ্গে নানানভাবে যুক্ত। পিকাসো নির্মাণ প্রাইভেট লিমিটেড, পিকাসো হলিডেস প্রাইভেটড লিমিটেড, পিকাসো আইএনএন প্রাইভেট লিমিটেড, পিকাসো ল্যান্ড অ্যান্ড হাউসিং প্রাইভেট লিমিটেড।
এই চারটি সংস্থাই একই ঠিকানায়। বিসি-১১৯, সল্টলেক, কলকাতা-৭০০০৬৪। আরও আশ্চর্যের হলো এই চারটি সংস্থাই তৈরি হয়েছে একই দিনে- ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল। আবার ঐ একই দিনে চারটি সংস্থাতেই ডিরেক্টর বনে যান জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের স্ত্রী মণিদীপা মল্লিক। চারটি সংস্থাতেই বোর্ড অব ডিরেক্টরসে মণিদীপা মল্লিকের সঙ্গে রয়েছেন জনৈক দুলাল মণ্ডল। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ এই ব্যক্তি। আরওসি’র তালিকা বলছে চারটি সংস্থাই ইতিমধ্যে পাততাড়ি গোটানোর পথে। আরওসি’র তথ্য বলছে এই সংস্থার বর্তমান স্ট্যাটাস – ‘ আন্ডার প্রসেস অব স্ট্রাইক অফ’! অর্থাৎ এই সংস্থা গুটিয়ে ফেলার জন্য, আরওসি’র তালিকা থেকেই সংস্থার নাম তুলে নেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। কোম্পানি অ্যাক্ট, ২০১৩’র ২৪৮ নম্বর ধারায় এই কোম্পানির ‘স্ট্রাইক অফ’ করা যায় যখন কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরস সেই সংস্থা আর জীবিত রাখতে চায় না।
তদন্তকারী সংস্থার দাবি, এই চারটি সংস্থার মাধ্যমেই রেশন দুর্নীতির টাকা রিয়েল এস্টেটের কারবারে বিনিয়োগ হয়েছিল। চারটি সংস্থার পিছনেই রয়েছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।
এর আগে শ্রী হনুমান রিয়েলকন প্রাইভেট লিমিটেড, গ্রেসিয়াস ইনোভেটিভ প্রাইভেট লিমিটেড, গ্রেসিয়াস ক্রিয়েশান প্রাইভেট লিমিটেড’ নামক তিনটি সংস্থার প্রসঙ্গে ইডি আদালতে জানিয়েছিল। এই তিনটি সংস্থাতেই ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি একই দিনে ডিরেক্টর হয়ে যান একসময়ে স্যালোন চালানো, পরবর্তীতে মন্ত্রীর বাড়ির পরিচারকের কাজ করা এবং কৃষি দপ্তরে চুক্তিভিত্তিক কর্মী রামস্বরূপ শর্মা। এই তিনটি সংস্থাতেই ২০২১’র আগে পর্যন্ত ডিরেক্টর ছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের স্ত্রী মণিদীপা মল্লিক ও কন্যা প্রিয়দর্শিনী মল্লিক।
এদিকে চারদিনের জেল হেপাজত শেষে এদিনই জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককের আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। যদিও সকালে তিনি ‘ফিট’ না থাকায় তাঁকে সশরীরে আদালতে তোলা হয়নি। তবে ভার্চুয়ালি শুনানিতে অংশ নেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে জেলের পরিবর্তে হাসপাতালে স্থানান্তরের আবেদনও জানিয়েছিলেন ধৃত মন্রীক্। গত কয়েকদিন ধরে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিক আবদার জুড়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। তাঁকে এসএসকেএমে ভর্তি করার দাবিও জানিয়েছিলেন। যদিও আদালতে এদিন তাঁর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার আবেদন খারিজ হয়ে যায়।
এদিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে শুনানির শুরুতেই বিচারক জ্যোতিপ্রিয়র কাছে তার সমস্যার কথা জানতে চাইলে জেল থেকে ভার্চুয়ালি তাতে অংশ নিয়ে জ্যোতিপ্রিয় বলেন, আমি আইনজীবী। হাইকোর্ট ও ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সদস্য। পায়ের সমস্যা হচ্ছে। ৩৫০ বেশি সুগার। স্যার আমাকে বাঁচতে দিন। বিচারক তখন তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন- ‘আপনি নিজেকে যখন আইনজীবী হিসাবে দাবি করছেন, তখন আপনি নিশ্চয়ই জেল এবং আদালতের এক্তিয়ার সম্পর্কে অবগত। একজন আইনজীবী হলে আপনার বুঝে যাওয়া উচিত। আপনার অসুবিধা শুনানি ছেড়ে সেলে চলে যেতে পারেন।
এরপরে ইডি’র তরফে জেলে গিয়ে জেরার আবেদন জানানো হয়। জেলে জেরার সময় ডিজিটাল গেজেট ব্যবহারের আবেদনও করা হয়। আদালত ইডির আইনজীবীর সেই আবেদন মঞ্জুর করেন। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের তরফে যদিও এদিন জামিনের আবেদন করা হয়। বিচারক ১৪ দিনের জেল হেপাজতের নির্দেশ দেন। আগামী ৩০ নভেম্বর মামলার ফের জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে আদালতে তোলা হবে।
Comments :0