‘‘বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল। দেড় বছর পর মন খুলে হাসলাম। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। বাচ্চাগুলোকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম’’, ধর্ষকরা আবার জেলে ফেরার পর যেন প্রাণ খুলে মনের কথা বলতে পারলেন বিলকিস বানো। সুপ্রিম কোর্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে সোমবারই নিজের অভিব্যক্তি উজাড় করে দেন তিনি । চিঠি পাঠায় শীর্ষ আদালতকে। আইনজীবী শোভা গুপ্তার মাধ্যমে পাঠানো সেই পত্রে বিলকিস বলেছেন, ‘‘আমার জন্য সত্যিই নতুন বছর। আনন্দে কেঁদে ফেলেছি। দেড় বছর পর আবার হেসেও ফেলি পরক্ষণেই।’’
গুজরাট গণহত্যার সময় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা দলবেঁধে বিলকিসকে ধর্ষণ করে। মামলা মহারাষ্ট্রে পাঠানো হলে আট বছর পর দোষীসাব্যস্ত হয় ধর্ষকরা। সেই ১১ জনকেই গুজরাট সরকার নির্বিকারচিত্তে মুক্তি দিয়ে দেয় ২০২২’র ১৫ আগস্ট, তাদের শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই। সেদিন থেকে ফের সন্তানদের নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বেঁচেছেন বিলকিস, তাঁর স্বামী ইয়াকুব রসুল। গুজরাটের বিজেপি সরকার এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে সুপ্রিম কোর্ট সোমবার ফের ধর্ষকদের জেলে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে এবং তা দু’সপ্তাহের মধ্যেই করতে হবে। স্বস্তি পেলেও বিলকিসের মধ্যে আতঙ্ক দানা বেঁধে আছে, যে কোনও সময়েই আবার মুক্তি পেয়ে যেতে পারে ধর্ষকরা। তবুও তিনি আশাবাদী। সোচ্চার কণ্ঠে বলেছেন, লড়াই চলবে।
স্বাধীনতা দিবসের ৭৫ বছরে যখন ধর্ষকদের ছেড়ে দেওয়া হলো সেদিন শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন বিলকিস। ধর্ষকদের আবার জেলে পাঠানোর পথ মসৃণ ছিল না। শক্তিশালী সরকারপক্ষের সঙ্গে ‘কোর্টরুম’ লড়াই চলেছে অবিরাম। ‘‘ধর্ষকদের মালা পরালে সমস্যা কোথায়?’’ প্রশ্ন করেছিলেন সরকারি আইনজীবী। এই কঠিন লড়াই পেরতে বিলকিসের হাত শক্ত করেন আরও তিন জন মহিলা— একজন রাজনীতিক, একজন অধ্যাপক এবং একজন সাংবাদিক। সিপিআই(এম) নেত্রী সুভাষিণী আলি, দর্শনের অধ্যাপক রূপরেখা ভার্মা এবং সাংবাদিক রেবতী লাউল। গুজরাট সরকারের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তাঁরা পিটিশন দাখিল করেন সুপ্রিম কোর্টে।
লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান রূপরেখা ভার্মা। সেদিন দিল্লি বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন লক্ষ্ণৌ যাবেন বলে। হঠাৎ এক বন্ধুর ফোন আসে। তিনি জানতে চান, রূপরেখা জনস্বার্থ মামলা দায়ের করতে চান কি না। বিন্দুমাত্র না ভেবেই রাজি হয়ে যান তিনি। পরের দিনই কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দেন আধার কার্ড। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে বর্ষীয়ান এই অধ্যাপক বলেন, বহু সমাজকর্মী এবং সাংবাদিক চিন্তিত ছিলেন ধর্ষকদের মুক্তি পেয়ে যাওয়ার বিষয়ে। একটি পিটিশন দাখিলের পরিকল্পনা চলছিলই। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যাই। গুজরাট সরকারের ওই নির্দেশে আমিও অত্যন্ত বিরক্ত ছিলাম।’’ অধ্যাপনার সঙ্গেই সমাজকর্মী হিসাবেও কাজ করেন রূপরেখা ভার্মা। লিঙ্গসাম্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় অবিচল তাঁর সংস্থা।
রূপরেখার রাজি হওয়ার আগেই সুভাষিণী আলি ঠিক করে নিয়েছিলেন, তিনি হবেন পিটিশনারদের মধ্যে অন্যতম। মহিলা সমিতির প্রতিনিধি হিসাবে ধর্ষণের পর বিলকিসের সঙ্গে একটি শিবিরে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। শুনেছিলেন, তাঁর কথা। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিকের কথায়, ‘‘বিলকিসের পাশে ওঁর স্বামী দাঁড়িয়েছিল সেদিন। বিলকিস তখন চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা। ও সাহস দেখেছিল। আর ধর্ষকরা ছাড়া পাওয়ার পর শুনলাম, বিলকিস বলেছেন যে তাহলে এখানেই কি বিচার শেষ? মনে হয়েছিল কারেন্ট খেলাম। আমরা তাহলে কী করছি? তখনই সিদ্ধান্ত নিই, পিটিশন জমা করব। কপিল সিবাল, অপর্ণা ভাট সহ খুব ভালো-ভালো আইনজীবীদের সাহায্য আমরা পেয়েছি।’’ বিজেপি সরকারকে তুলোধনা করে সিপিআই(এম) নেত্রী বলেন, ‘‘দোষী সাব্যস্ত হয়ে ধর্ষকরা জেলে গেল। কিন্তু প্রায়ই ওদের প্যারোলে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হতো। নির্লজ্জের মতো সরকার ওই দুর্বৃত্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে এতদিন ধরে। সরকারের উচিত দুর্বলের পাশে থাকা, যাঁর সুরক্ষার প্রয়োজন। আর তারপরে তো মুক্তিই দিয়ে দেওয়া হলো ধর্ষকদের।’’
দু’জন আবেদনকারী চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পরে যখন তৃতীয় ব্যক্তির খোঁজ চলছে, তখনই উঠে আসে রেবতী লাউলের নাম। সর্বভারতীয় এক সংবাদপত্রে সাংবাদিক বলেছেন, ‘‘আমি সাংবাদিকতার সুবাদেই বিলকিসের সঙ্গে দেখা করেছিলাম ঘটনার ঠিক পরেই। বই-ও লিখেছি। এককথাতেই রাজি হয়ে যাই।’’
ন্যায়বিচারের দাবিতে তাঁদের সঙ্গেই হাজারো মহিলা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন, লিখিত আবেদন জমা দিয়েছেন, খোলা চিঠি লিখেছেন। বিলকিস বলেন, ‘‘এঁরা দেশের সমস্ত মহিলার মধ্যে ন্যায়বিচারের তাগিদ জাগিয়ে তুলেছেন।’’ স্বামী সহ সমস্ত পরিজনদের ধন্যবাদ দিয়েছেন বিলকিস, তাঁর লড়াইয়ে পাশে থাকার জন্য।
অন্যদিকে, এনসিপি প্রধান শারদ পাওয়ার মঙ্গলবার মহারাষ্ট্র সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘‘আমি অনুরোধ করছি, বিলকিস বানো মামলাতে যেন যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট যা বলেছে, তা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।’’ নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে একহাত নিয়ে তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন বলেছেন, ‘‘এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে শীর্ষ আদালতের রায় আলোকরশ্মির মতো, যা বিশ্বাস করতে শেখায়।’’
Bilkis Bano
সুভাষিণী আলিদের হাত ধরেই চলে লড়াই
×
Comments :0