Economic scam by TMC

তৃণমূলের বিধায়কের বাড়িতে উদ্ধার ২৮ লক্ষ টাকা, সোনা

জেলা

বৃহস্পতিবার বিকালে মুহূর্তেই যেন ফিরে এলো দেড় বছর আগে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডেই ধৃত প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জির দুটি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়া লক্ষ লক্ষ নগদ টাকা গোনার সেই দৃশ্য!
অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ ডোমকলের তৃণমূলের বিধায়ক জাফিকুল ইসলামের বাড়ির শৌচালয় থেকে বেডরুম— তল্লাশিতে উদ্ধার হলো লক্ষ লক্ষ টাকা। রাতে সিবিআই সূত্রে জানা গেছে উদ্ধার হওয়া টাকার পরিমাণ ২৮ লক্ষ। থরে থরে সাজানো সব পাঁচশো টাকার বান্ডিল। গোনার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে আনা হলো টাকা গোনার মেশিনও। বিকাল থেকে টানটান উত্তেজনা টিভির পর্দায়, নগদ টাকার পরিমাণ কত হয়! অভিষেক ব্যানার্জির অনুগামী বলেই পরিচিত কয়েক বছর আগেই তৃণমূলে যোগ দেওয়া এই জাফিকুল ইসলাম। কয়েক বছর তৃণমূলে এসেই বিপুল সম্পত্তি, টাকার মালিক বনে যাওয়া জাফিকুল রীতিমত প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তিনি হয়েছেন এতটাই প্রভাবশালী।
বৃহস্পতিবার সকাল সাতটায় ডোমকল পৌরসভার গোবিন্দিপুরে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে জাফিকুল ইসলামের প্রাসাদে এসে পৌঁছায় সিবিআই’র আধিকারিকর। বাড়ি ঘিরে ফেলে কেন্দ্রীয় বাহিনী। যদিও বাড়িতে ছিলেন না বিধায়ক। বিধানসভা অধিবেশনেও যোগ দেননি। তবে সকালে এমএলএ হস্টেলে ছিলেন বলে জানা গেছে। তিনি কোথায় তা জানা যায়নি রাত পর্যন্ত। 
সকাল থেকেই বাড়ির পাশাপাশি টানা তল্লাশি চলছে জাফিকুল ইসলামের বিএড কলেজে, ডিএলএড কলেজেও। প্রায় ৭ কাঠা জমি জুড়ে রয়েছে জাফিকুল ইসলামের বাড়ি। জাফিকুল ইসলামের সেই বিশাল বাড়ির নিচেই রয়েছে ‘বিধায়ক কার্যালয়’, সেটাই এলাকার তৃণমূলের অফিস। সেই অফিসেও চলে তল্লাশি। 
বড়ঞার জীবন কৃষ্ণ সাহার মতোই তৃণমূলের রাজনীতিতে দ্রুত উত্থান জাফিকুলের। ২০১৭ সালে ডোমকল পৌরসভা ভোটে রাজনীতির ময়দানে নামেন জাফিকুল ইসলাম। সেই সময় একটি ডিএলএড কলেজের মালিক ছিলেন জাফিকুল। সৌমিক হোসেনের শাগরেদ হিসাবেই দাঁড়ান পৌরসভা ভোটে। ব্যাপক ভোট লুটের পর পৌরসভা দখল করে তৃণমূল। চেয়ারম্যান হন সৌমিক হোসেন। দাপুটে সৌমিককে ২০১৯ সালের জুলাই মাসেই ডোমকল ছাড়া করেন এই জাফিকুল। তৃণমূল সূত্রে খবর, সেই জন্য খরচ করেছেন মোটা অঙ্কের টাকাও। সেই চেয়ার দখল করেন জাফিকুল। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাননি। একুশের ভোটে তৃণমূলের টিকিট পান জাফিকুল। একুশের বিধানসভা ভোটের ঠিক আগের দিন এই জাফিকুল ইসলামের কনভয়ের গাড়িতে পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় এক সিপিআই(এম) কর্মীর। ২০২২ সালে ডোমকল পৌরসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও ভোট হয়নি। পৌরসভার প্রশাসকের দায়িত্বও পান জাফিকুল ইসলাম। 
ভোটের পরও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে জাফিকুলের সম্পত্তি। সম্প্রতি কিনেছেন একটি পেট্রোল পাম্পও। ডোমকলের স্থানীয়রাই জানাচ্ছেন, নেহাত শিক্ষা দুর্নীতি নয় সীমান্তে পাচারের কাজও চালায় জাফিকুল ইসলামের বাহিনী। বিধায়কের পরিকল্পনাতেই ডোমকল জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর কোন্দল থেকে গ্রাম্য বিবাদ। কিছু হলেই সামনে আসছে অস্ত্র ভান্ডারের ছবি। সেই অস্ত্র আর পুলিশের জোরেই ডোমকলে পঞ্চায়েত ভোট লড়েছে তৃণমূল। 
এই ডোমকলেই বাড়ি অনুব্রত মণ্ডলের প্রাক্তন দেহরক্ষী সায়গল হোসেনের। তার সাথে যোগাযোগ নিয়েও উঠছে প্রশ্নও। যদিও জাফিকুল ইসলাম ফোনে দাবি করেছেন, ওই টাকা তাঁর নিজের জমি বিক্রির টাকা। অবশ্য উদ্ধার হওয়া ১২ভরি সোনার কোনও কাগজ দেখাতে পারেননি তিনি। এর মধ্যে প্রায় চার লক্ষ টাকা তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে। দাবি, সেটা নাকি সংসার খরচের জন্য রাখা ছিল! 
বাড়ির অদূরে গোবিন্দপুরে ১ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে রয়েছে জাফিকুল ইসলামের শিক্ষা ব্যবসার সাম্রাজ্য। ১২টি বিএড, ডিএলএড কলেজ। ১টি পলিটেকনিক কলেজ। ১টি ফার্মাসি কলেজ। রয়েছে সৈয়দ মেমোরিয়াল পিটিটিআই, ড. আম্বেদকর প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ডোমকল বিএড কলেজ, গোবিন্দপুর অ্যাকাডেমিক পিটিটিআই। সবকটি কলেজের মালিকই জাফিকুল ইসলাম। কলেজগুলিতেও তল্লাশি চালান সিবিআই আধিকারিকরা। এই কলেজগুলির সাথে নিয়োগ দুর্নীতির যোগ খুঁজছে সিবিআই। 
একইসঙ্গে এদিন মুর্শিদাবাদের বড়ঞার কুলিতে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ শিক্ষা ব্যবসায়ী সজল আনসারির বাড়িতেও চলে সিবিআই তল্লাশি। এই পরিবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে সরাসরি তৃণমূলের হয়ে মাঠে নেমেছিল। কুলি গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের হয়ে জিতেছেন এই পরিবারেরই সদস্য। প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে তল্লাশি চালানোর পর সন্ধ্যাবেলায় বড়ঞার কুলিতে ওই ব্যবসায়ীর বাড়ি ও কলেজ থেকে বেরিয়ে যান  আধিকারিকরা। সিবিআই সূত্রে জানা গেছে বাড়ি ও কলেজ থেকে উদ্ধার হয়েছে ওএমআর শিট ও বেশ কিছু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিবরণ। বাড়ি থেকে একটি মোবাইল ফোনও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। 
সকাল ৯টা থেকে বড়ঞার বাসিন্দা সজল আনসারির বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই দল। দুপুরে আখেরদিঘি এলাকায় বিএড কলেজে হানা দেয় সিবিআই-এর দল। বাড়িতে তল্লাশির পাশাপাশি বিএড কলেজেও দিনভর তল্লাশি চালানো হয়। কলেজে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় সজল আনসারির ভাই চঞ্চল আনসারিকে। কিছুক্ষণ পর কলেজে নিয়ে আসা হয় সজল আনসারির বাবা আনারুল আনসারিকেও। কলেজ ও বাড়িতে টানা তল্লাশি চালানোর পর ৫টা নাগাদ দুই জায়গা থেকেই বেরিয়ে যান সিবিআই দল। সজল আনসারি নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে ধৃত কুন্তল ঘোষের ঘনিষ্ঠ বলেই জানা গিয়েছে। একাধিক বিএড, ডিএলএড কলেজ রয়েছে এই পরিবারের।  
এই ঘটনায় মুখ পুড়ছে ডোমকলেরও। ১৯৯১ থেকে ২০২১ অবধি ডোমকলের বিধায়ক ছিলেন আনিসুর রহমান। তার আগে ডোমকলের বিধায়ক ছিলেন আব্দুল বারি। দুই সিপিআই(এম) নেতার সহজ জীবন ডোমকলের মানুষ এখনও স্মরণ করেন। কোনদিন দুর্নীতির আঁচও লাগেনি তাঁদের। সিপিআই(এম) ডোমকল এরিয়া কমিটির সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানের অভিযোগ, “রাজ্যের যুবক-যুবতীদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এই দুর্নীতির অর্থ সরাসরি ব্যবহার করা হয়েছে রাজনীতিতে। এই টাকা দিয়ে ডোমকলে অশান্ত করা হচ্ছে।’

 

Comments :0

Login to leave a comment