GARDEN REACH ILLEGAL CONSTRUCTION

তৃণমূল-থানার আঁতাতেই অবাধ বেআইনি নির্মাণ চলে মহানগরে

কলকাতা

 

গার্ডেনরিচের ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে কর্পোরেশন ভোটের সময় কোনও বিরোধী দলকে প্রার্থী দিতে দেওয়া হয়নি। মেয়র ফিরহাদ হাকিমের ঘনিষ্ঠ শামস ইকবালই একমাত্র প্রার্থী ছিলেন শাসক তৃণমূলের হয়ে। নির্দল হিসাবে একজন মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন বটে, তারপর থেকে তিনি এলাকাছাড়া ছিলেন তৃণমূলী সন্ত্রাসে, প্রচার তো দূর অস্ত। ৯৮ শতাংশের ওপর ভোট পেয়ে এই শামস ইকবাল জেতেন।
একচ্ছত্র দাপট আর দখলদারির এই চেহারাই আসলে বেআইনি নির্মাণের রমরমা পূর্বশর্ত। শামস ইকবালের মতো কাউন্সিলররা শুধু দল ও দলীয় নেতাদের টাকার জোগান দেন তা নয়, ভোট বাক্সেও মুনাফা দেন। ফলে বিধায়ক হিসাবে, মন্ত্রী হিসাবে ফিরহাদ হাকিমকেও বছরের বাকি দিন এদের রক্ষাকবচ হয়েই থাকতে হয়। 
শুধুমাত্র এই ১৩৪ ও লাগোয়া ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডেই ৫০ জনের মতো প্রোমোটার আছে। আর সেই প্রোমোটারদের পোষা বাহিনীর সংখ্যা প্রায় হাজারের বেশি। শুধু বেআইনি নির্মাণ নয়, ব্যক্তিগতভাবে কেউ নিজের বাড়ি একতলা থেকে দোতলা করতে গেলেও টাকা দিতে হবে এই ‘গ্যাঙ’র কাছে, তবেই মিলবে ছাড়পত্র। তার সঙ্গেই যোগ্য সঙ্গত দেয় স্থানীয় থানা। এক্ষেত্রে গার্ডেনরিচ থানা। ঝুপড়ির ওপর ভেঙে পড়া বহুতল থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে তৃণমূলের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে মঙ্গলবার সকালে এক যুবক বলছিলেন, ‘থানা সব জানে, থানায় বসে রেট ঠিক হয়। তারপরে আর গার্ডেনরিচ থানার কিছু করবে! মিডিয়ায় হই চই তাই একটা প্রোমোটারকে ধরে কোনোভাবে মুখরক্ষা করতে চাইছে, ভোটের পরে এমনি দেখবেন ছাড় পেয়ে যাবে ধৃতরা।’
ভুক্তভোগীরা জানাচ্ছেন, কাটমানির রেট ঠিক হয় থানা থেকে। কাউন্সিলরের অফিসে আগে ডাক পড়ে। কথা না শুনলে থানা ডেকে পাঠায়। বৈধ নকশা থাকলে একরকম রেট। নকশা বৈধ না হলে স্কোয়ার ফুট পিছু রেট দ্বিগুণ হয়ে যায়। গলি থেকে রাজপথ, রেটের তারতম্য শহর জুড়ে। বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ আদালত অবধি গড়ালে কেস তুলে নেওয়ার রফাসূত্র দেয় থানা। হয় বিপুল টাকার লেনদেন।  কিন্তু কোনও ক্ষেত্রে এই স্তরে রফা না হলে বহুতল ভাঙা হয়। তারপর কোণঠাসা প্রোমোটারের সঙ্গে ফের রফা হয় থানার মাধ্যমে। 
কেমন পদ্ধতিতে চলে এই বেআইনি নির্মাণের কাজ? ঢালাইয়ের প্রথম ধাপে স্থানীয় কাউন্সিলরকে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। তারপর বহাল তবিয়তে করা যায় বেআইনি নির্মাণ। গার্ডেনরিচ ও তার আশপাশে এই সমীকরণেই রমরমিয়ে চলছে বেআইনি বহুতল নির্মাণের কারবার। এদিন এই অভিযোগই করলেন পাহাড়পুর এলাকার বাসিন্দা জয়ব্রত বেরা। বাসিন্দাদের কথায়, নির্মাণের জন্য চিহ্নিত জায়গার বিষয়ে প্রথমে জানানো হয় শাসক দলের বাহিনীকে। এরপর জমি নিচু হলে তা ভরাটের জন্য বরাত দিতে হয়। সেই বাহিনীই প্রোমোটারের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে এলাকাকে ‘কন্ট্রোল’ করে, তারপর রফা হয় বর্গফুট পিছু রেটের নিরিখে। 
গার্ডেনরিচ এলাকার ৭টি ওয়ার্ডেই এই সমীকরণে রমরমিয়ে চলে বেআইনি নির্মাণ। অথচ দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে এলাকার বিধায়ক থাকা সত্ত্বেও এলাকার বিধায়ক তথা কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলছেন, তিনি নাকি এই বেআইনি নির্মাণ সম্পর্কে কিছুই জানেন না! ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলর শামস ইকবালকে আড়াল করতে ফিরহাদ বলেন, ‘কাউন্সিলর তো পরে। এটা তো দেখার কাজ বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের আধিকারিকদের। যাঁরা মাইনে পান। আমরা তাঁদের শোকজ করেছি।’ তাঁর এই বক্তব্যের পালটা প্রতিক্রিয়ায় কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ বলেন, ‘আমি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শুনেছি, উনি এই অবৈধ নির্মাণের কথা জানতেন না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু আমি যদি এলাকার কাউন্সিলর হতাম, আর আমার এলাকায় যদি এমন ঘটনা ঘটত, তা হলে আমি এই ঘটনার দায় এড়াতে পারতাম না।’ 
এদিনই এবার এলাকায় তৃণমূল কাউন্সিলর শামস ইকবাল জানিয়েছেন, সরকারি ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি সে নাকি নিজেই মৃতদের পরিবারপিছু ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবেন। এখনও পর্যন্ত দশজন মারা গিয়েছেন। অর্থাৎ এক কোটি টাকা। একজন কাউন্সিলর নিজের পকেট থেকে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন, অথচ তিনি নিজেই বলেছেন বেআইনি নির্মাণ নিয়ে কিছু জানেন না। 
অন্যদিকে কর্পোরশনের আধিকারিকরাই বলছেন, মেয়রের দাবি ৮৩২টি বহুতল ভাঙা হয়েছে। সেই তালিকায় খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, বহু ক্ষেত্রে ফের নির্মাণ শুরু হয়েছে। ৪ বার করে এফআইআর’র পরেও নির্মাণ হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। সবই হয়েছে থানা চোখ বন্ধ করে থাকে বলে। গার্ডেনরিচের ভেঙে পড়া বাড়িটি ডোবা বুজিয়ে তৈরি করা। জলাশয় থেকে বাস্তুজমিতে রূপান্তরিত হয়েছে বিএলআরও অফিসের মাধ্যমে। 
সিপিআই(এম) নেতা প্রতীম ঘোষের কথায়, ‘‘আসলে একটা ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছে তৃণমূল। তাই মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারেন না। গোটা এলাকা জুড়ে দিনের পর দিন অপরাধীদের রমরমা, কোটি কোটি টাকার খেলা চলছে। মুখ্যমন্ত্রীও জানেন। টাকার যোগান আর ভোটের জোগান দুটোই দেয় এই বাহিনী— তাই সাত খুন মাফ।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment