রামমন্দিরের উদ্বোধনের দিন যত এগিয়ে আসছে, এরাজ্যে মন্দির নির্মাণে খরচ করতে রাজ্য সরকার কতটা আগ্রহ দেখিয়েছে তাকে প্রচারের আলোয় আনতে উঠেপড়ে লেগেছেন মমতা ব্যানার্জি।
রামমন্দির নিয়ে প্রশ্ন শুনে মমতা ব্যানার্জি জানিয়েছেন,‘‘আপনি যান না। আপনাকে যাওয়ার জন্য কেউ বারণ করেনি।’’ সিপিআই(এম)’র তরফ থেকে আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদ মাধ্যমে সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি স্পষ্ট ভাষায় যাচ্ছেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। একইভাবে কংগ্রেসও ২৪ ঘণ্টা আগে স্পষ্ট করেছে রামমন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠান বয়কটের সিদ্ধান্ত। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি ও তৃণমূল কী করতে চলেছেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। তার কারণ, দল হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস আমন্ত্রণ পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ব্যানার্জি আমন্ত্রিত কিনা সেটাও তিনি জানাচ্ছেন না। রামমন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দল কিংবা মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা কী হবে তা এদিনও স্পষ্ট না করে ধোঁয়াশা রেখেছেন মমতা ব্যানার্জি। পরিবর্তে সামনে এনেছেন বিপুল সরকারি খরচে এরাজ্যে কীভাবে ধর্মকে প্রচারে রাখতে চায় নবান্ন।
এদিন নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মমতা ব্যানার্জি নিজেই জানিয়েছেন,‘‘৭০০ কোটি টাকার ওপর সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে খরচ করেছি। তারসঙ্গে গঙ্গাসাগরের মেলার জন্য আলাদা করে এবছর ২৫০ কোটি টাকা খরচ করছি।’’ জনগণের টাকার ১ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তার বাইরে আছে বিপুল পরিমাণ জমি। যা তুলে দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে। সেই জমির আর্থিক মূল্য ধরলে হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে সরকারি খরচ।
২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নয়া সংসদ ভবনে সাক্ষাৎ করে এরাজ্যের ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা সহ কেন্দ্রের কাছে বকেয়া দাবি করে এসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সংবাদমাধ্যমের কাছে তুলে দিয়েছিলেন দাবির একটি চিঠিও। এদিন ফের প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দুটি চিঠি দিয়েছেন। একটি চিঠি গঙ্গাসাগর মেলাকে জাতীয় স্বীকৃতির দাবি করে। অন্য চিঠিতে বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দাবি করে। এরাজ্যের মানুষের কাজ ও আবাসের দাবির কথা আর বলতে চাইছেন না মমতা ব্যানার্জি।
নতুন বছরে এটাই নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন ছিল। তাঁর সঙ্গে এদিন উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের নয়া মুখ্যসচিব বিপি গোপালিকা, নয়া স্বরাষ্ট্র সচিব নন্দিনী চক্রবর্তী, প্রাক্তন দুই মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী। নতুন বছরের প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনের কারণ হিসাবে মমতা ব্যানার্জি শুরুতেই জানান,‘‘সরকারের তরফ থেকে নতুন বছরের প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের কিছু কথা বলব। এটা পুরোপুরি সরকারি কর্মসূচি।’’ ফলে সাংবাদিক সম্মেলনেই মমতা ব্যানার্জি এদিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন ধর্মীয় স্থানে সরকারের বিপুল অর্থ খরচকেই সরকারি উন্নয়নের প্রচার হিসাবে সামনে আনা হবে।
সেই কাজে প্রথমে আছে দীঘায় জগন্নাথ মন্দির। রাজ্যের পৌর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের অধীনস্থ হিডকো সংস্থা জগন্নাথ মন্দির নির্মাণে ২০৫ কোটি টাকা খরচ করছে। মুখ্যমন্ত্রী এদিন জানিয়েছেন আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যেই শেষ করা হবে দীঘার জগন্নাথ ধাম। জগন্নাথ মন্দিরের ঠিক পরেই আছে কালীঘাট মন্দিরের সংস্কার। রাজ্য সরকার এই মন্দির সংস্কারে খরচ করছে ১৬৫ কোটি টাকা। কালীঘাট মন্দিরে সংস্কারের জন্য রিলায়েন্স গোষ্ঠী ৩৫ কোটি টাকা খরচ করছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এদিন কিছুটা আক্ষেপের সুরে জানিয়েছেন,‘‘ কালীঘাটে মন্দির হচ্ছে। সবাই বলছে ওটা রিলায়েন্স করছে। তা কিন্তু নয়। ওর সোনার চূড়াটা শুধু করছে। ১৬৫ কোটি টাকা আমরা খরচ করছি।’’ কীভাবে হকারদের সরিয়ে মন্দির নির্মানের কাজ চলছে তা দেখার জন্য এদিন বৈঠক থেকেই কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম ও কলকাতা পুলিশকে ১ বৈশাখের মধ্যে কাজ শেষ করা নির্দেশ দিয়েছেন।
ধর্মীয় বিভাজনকে তীব্র করে রাজ্য বিধানসভার ভোট হয়েছিল নন্দীগ্রামে। রাজ্যের বিরোধী দলেনেতার কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সেই নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়াতে সিদ্ধিনাথ জিউ মন্দিরের জন্য মমতা ব্যানার্জির সরকার ১৭ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকা খরচ করেছে। ওঙ্কারনাথ মন্দিরের গেট ও রাস্তার জন্য সরকারি কোষাগার থেকে খরচ হয়েছে ১৩ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা। উত্তরবঙ্গের জল্পেশ মন্দিরে জন্য ৩১ কোটি টাকা খরচ করার কথা জানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। গঙ্গাসাগর মেলার জন্য চলতি বছরে রাজ্য সরকার ২৫০ কোটি টাকা খরচ করার পরেও কেন এই মেলাকে জাতীয় মেলার স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না, সেই অভিযোগ করে নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। টাইপ করা চিঠিতে নিজের হাতে মকর সংক্রান্তির শুভেচ্ছা পর্যন্ত লিখে দিয়েছেন।
ধর্মীয় স্থান সংস্কারে শীর্ষে আছে বীরভূম জেলা। এই জেলায় একের পর মন্দিরের সংস্কার করার জন্য টাকা খরচ করা হয়েছে। নানুরের শিবমন্দির, নলহাটেশ্বরী মন্দিরের জন্য ১ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা, বক্রেশ্বর, কঙ্কালীতলা থেকে ফুল্লরা মন্দিরের জন্য ১ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এদিন বলেছেন,‘‘ সরকারের পক্ষ থেকে ধর্মীয় স্থান, তীর্থস্থানের জন্য টাকা খরচ করা হয়েছে। যতটুকু আপনারা(সাংবাদিক) লিখতে পারেন ততটুকু বললাম। আপনাদের(সাংবাদিক) ওপর যাতে প্রেসার না পড়ে সেটুকু বললাম।’’ আসলে সরকারি টাকা খরচের তালিকা আরও দীর্ঘ। শুধু আর্থিক বরাদ্দ করাই নয়। বিপুল জমি তুলে দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় সংগঠনের হাতে। মায়াপুরের ইস্কন মন্দিরের জন্য ৭০০ একর জমি আগেই তুলে দিয়েছে রাজ্য সরকার। অনুকূল ঠাকুরের মন্দিরের জন্য ৫ একর জমি তুলে দেওয়ার ঘোষণা এদিন করেছেন মমতা ব্যানার্জি।
Mamata Banerjee
রাজ্যে মন্দিরের পিছনে সরকারি খরচের ফিরিস্তি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
×
Comments :0