গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ বহুতল ভাঙার ৩৬ ঘণ্টা পরেও শেষ করা গেল না উদ্ধারের কাজ। ধ্বংসস্তূপে পরিণত বহুতল ঘিরে শুধুই কাজ চলছে। উদ্ধার কাজের গতি শ্লথ, ক্ষুব্ধ পাহাড়পুর এলাকার মানুষ। ধ্বংসস্তূপে এখনও কেউ আটকে থাকতে পারেন, এই আশঙ্কার পরেও আলোর অভাবে সোমবার দীর্ঘসময় বন্ধ থাকে কাজ। মঙ্গলবার সকালে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ টের পাওয়া গেল।
‘আমার ভাই ছ’ঘণ্টা জিন্দা (বেঁচে) ছিল, ওরা ধ্বংসস্তূপ সরাচ্ছিল না, কাউকে ছাড়ব না আমি, কাউকে না’— পুলিশি ব্যারিকেডের সীমানা পেরিয়ে বছর তিরিশের এক যুবককে এদিন মারমুখী হতে দেখা গিয়েছে। ওই যুবকের ভাইকে এদিন সকালে ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে বের করা হয়েছে। স্বজন হারানোর যন্ত্রণা রাগে পরিণত হওয়ায় রাস্তার ইট তুলে তিনি মারতে উদ্যত হন। এদিন মহম্মদ জামিল (৪০) নামে একজনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করার পর বহুতল ভাঙার ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ১০। এখনও মনে করা হচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকতে পারেন কেউ।
নিহতের পরিজনদের রাগের প্রকাশ যাতে সংবাদমাধ্যমের কাছে পৌঁছাতে না পারে সেজন্য সকাল থেকেই তৃণমূলের ‘দাদা’রা উপস্থিত ছিল। এরমধ্যে কেউ মোবাইল ফোন করে কিছু রেকর্ড বা ছবি তুলতে গেলেই রে রে করে ছুটে আসছে সেই ‘দাদা’রা। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা, ‘ফোন যেন বের করা না হয়। তাহলে নিয়ে নেওয়া হবে।’ এর পাশাপাশি পুলিশি ঘেরাটোপ তো রয়েছেই। এদিন হাসপাতালেও কোনও আহত ব্যক্তিদের দেখতে দেওয়া হচ্ছিল না বহিরাগতদের। এদিন পুলিশ মহম্মদ শারফরাজ ওরফে পাপ্পু ওরফে টিএমসি পাপ্পুকে (৪৬) গ্রেপ্তার করেছে। বহুতলটির জমি শারফরাজের নামে ছিল।
এরই মধ্যে ১৫ নম্বর বরোর ৪ জন বিল্ডিং বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারকে বদলি করা হয়েছে। মঙ্গলবার বহুতলের প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম পুলিশ ভ্যানে ওঠার আগে সাংবাদিকদের পরিষ্কার জানায়, ‘ইঞ্জিনিয়ার জানত।’ সে নির্দিষ্ট কোনও ইঞ্জিনিয়ারের নাম না করলেও পরিস্থিতির চাপে ওই বরো এলাকার বিল্ডিংয়ের ৪ জনকে সরিয়ে দেওয়া হলো। ওই বদলিকে স্বাভাবিক বদলি বোঝাতে সেই তালিকায় জুড়ে দেওয়া হলো আরও ৪ জনের নাম।
মঙ্গলবার মহম্মদ ওয়াসিমকে আলিপুর আদালতে তোলা হলে তাকে ১৪ দিনের পুলিশি হেপাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রোমোটারের সঙ্গে ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর শামস ইকবালের ছবি সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। কাউন্সিলর-প্রোমোটারের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে সকলেই কমবেশি প্রশ্ন তুলেছেন। এলাকার মানুষরা অভিযোগ, ওয়াসিম ওই কাউন্সিলের জামাকাপড়ের ব্যবসাটি পরিচালনা করে।
কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড শাখা বাড়ি ভাঙার তদন্ত শুরু করেছে। জখমদের নামের তালিকা তৈরি করে তাঁদের ওপর নজর রেখে চলতে দেখা যাচ্ছে গোয়েন্দাদের।
হাসপাতালের বাইরে ঘেরাটোপ তৈরি করা হয়েছে এদিন। নিজের বিধানসভা এলাকায় এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর কলকাতার মেয়র এখন শুধুই চারিদিকে দোষ দেখে চলছেন। এদিন মেয়র ফিরহাদ হাকিমের মুখে শোনা যায়, ‘বেআইনি নির্মাণ সামাজিক ব্যাধি, আটকাতে পারছি না!’ গার্ডেনরিচের ঘটনায় শুধুই কর্পোরেশনের আধিকারিকদের দোষের কথা প্রথম থেকেই বলে আসছেন মেয়র। এমনকি এদিন তিনি আরও কয়েক পা এগিয়ে এলাকার তৃণমূলের কাউন্সিলর শামস ইকবালকে ক্লিনচিট দিয়েছেন।
অথচ গার্ডেনরিচ, মোমিনপুর, খিদিরপুরে কান পাতলেই শোনা যায় খোদ মেয়রের পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে কাউন্সিলর, প্রোমোটার, পুলিশ আর কর্পোরেশনের কিছু কর্মী গাঁটছড়া বেঁধে বেআইনি কাজ চালাচ্ছে। আর সেটা নিয়ে প্রশ্ন করলেই মেয়রের যুক্তি, ‘কাউন্সিলর তো পরে। এটা তো দেখার কাজ বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের আধিকারিকদের। যাঁরা মাইনে পান। আমরা তাঁদের শোকজ করেছি। ভিতের সময়েই যদি ধরা যায় তা হলে এগুলো হয় না।’
তবে এমন গুরুতর ঘটনায় কর্পোরেশন যে দায় এড়াতে পারে না তা এদিন জানিয়েছেন কলকাতা কর্পোরেশনের ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ। কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র পরিষদে বিল্ডিং বিভাগের দায়িত্ব রয়েছেন খোদ মেয়র ফিরহাদ হাকিম। এদিন কর্পোরেশের তরফে নতুন করে ধৃত প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম ও তাঁর দুই ব্যবসায়িক পার্টনার মহম্মদ নাসিম এবং রাজার বিরুদ্ধে বেআইনি বাড়ি তৈরির অভিযোগ করা হয়েছে।
এদিন গার্ডেনরিচের ঘটনাস্থলে যান আইএসএফ বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকী। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন।
GARDEN REACH ILLEGAL CONSTRUCTION
দোষীদের আড়ালের চেষ্টা মেয়রের
×
Comments :0