Ed Raid

সুজিত বসু, তাপস রায়ের বাড়িতে ইডি'র ম্যারাথন তল্লাশি

রাজ্য

শুক্রবার সাতসকালে পৌর নিয়োগ দুর্নীতিতে ম্যারাথন তল্লাশি চালালো কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। রাজ্যের দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু, বরানগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায় এবং উত্তর দমদম পৌরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর সুবোধ চক্রবর্তীর বাড়িতে তল্লাশি চালায় ইডি। সন্দেশখালির ঘটনার প্রেক্ষিতে এদিন তিন জায়গাতেই বিশাল কেন্দ্রীয় বাহিনীর সুরক্ষা নিয়ে তল্লাশি চালান ইডি’র আধিকারিকরা।
প্রায় ১৪ ঘণ্টা তল্লাশির পর রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ইডি’র আধিকারিকরা। জানা গিয়েছে, তাঁরা বাজেয়াপ্ত করেছেন বহু নথি। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে সুজিতের মোবাইল ফোনও। বরানগরের তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়ের বউবাজারের বাড়িতে এদিন হানা দেয় ইডি। প্রায় ১২ ঘণ্টা তল্লাশি চলে সেখানে। উত্তর দমদম পৌরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুবোধ চক্রবর্তী আগে উত্তর দমদম পৌরসভার চেয়ারম্যানও ছিলেন। শুক্রবার সকাল পৌনে ৭টা নাগাদ বিরাটির খলিসাকোটা পল্লিতে তাঁর বাড়িতে ঢোকে ইডি’র আধিকারিকের দল। সেই বাড়ির চারপাশেও মোতায়েন ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী।
ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, পৌর নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডেই এই তল্লাশি অভিযান। এই কেলেঙ্কারিতে ইতিমধ্যেই ধৃত অয়ন শীলকে জেরার ভিত্তিতে পাওয়া তথ্যের সূত্রে তল্লাশি চালিয়েছে ইডি। প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সা‍‌লের ওয়েস্ট বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট-কে সরাসরি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজ্যের পৌর প্রশাসনের মদতেই প্রোমোটার অয়ন শীলের সংস্থার মাধ্যমে একের পর এক পৌরসভায় অবৈধ নিয়োগ হয়েছে। এই অয়ন শীল দু’টি সংস্থার ডিরেক্টর। দু’টি সংস্থারই জন্ম তৃণমূল সরকারের আমলে। একটি সংস্থার মাধ্যমে রাজ্যের প্রায় অধিকাংশ পৌরসভায় বেআইনি নিয়োগ হয়েছে, আরেকটি সংস্থা সেই সব পৌরসভার যাবতীয় নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজের বরাত পেয়েছে। এতটাই প্রভাবশালী ছিল সামান্য এক প্রোমোটার অয়ন শীল? পিছনে কার মদত? কীভাবে গোটা পৌর প্রশাসনকে পকেটে পুরে গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চালানো হলো দুর্নীতির এই নেটওয়ার্ক? টাকার ভাগ কোন শীর্ষস্তর পর্যন্ত পৌঁছাতো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই দফায় দফায় জেরা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। 
এখন পর্যন্ত রাজ্যের মোট ৬০টি পৌরসভায় এমন টাকার বিনিময়ে নিয়োগের হদিশ মিলেছে। মূলত দক্ষিণবঙ্গের ৬০টি পৌরসভা। দমদম পৌরসভা, উত্তর ও দক্ষিণ দমদম পৌরসভা থেকে কামারহাটি, পানিহাটি, বারাকপুর, বরানগর, হালিশহর, হুগলী, হাওড়ার একাধিক পৌরসভায় এমন টাকার বিনিময়েই চাকরিতে নিয়োগ হয়েছে। পার্থ-মানিক-শান্তনু-কুন্তলের বাহিনী টাকার বিনিময়ে সরকারি স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বিক্রির অভিযান যখন চালাচ্ছে, ঠিক তখনই পাল্লা দিয়ে চলছে রাজ্যের একের পর এক পৌরসভায় টাকার বিনিময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া!
অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ ও নিয়োগকাণ্ডে ধৃত শান্তনু ব্যানার্জির বন্ধু সেই প্রোমোটার অয়ন শীলের মাধ্যমে তৃণমূলের পৌরসভার দুর্নীতির মডেল ঠিক কেমন? তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ শান্তনু ব্যানার্জির ‘বন্ধু’ অয়ন শীলের সংস্থাকেই পৌরসভার নিয়োগের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি এজেন্সি হিসাবে চিহ্নিত করেছিল রাজ্য সরকার। অধিকাংশ পৌরসভায় নিয়োগের বরাত পেয়েছিল ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের সংস্থা এবিএস ইনফোজোন প্রাইভেট লিমিটেড। ২০১৩ সালের ১৬ জুলাই জন্ম হয় এই এবিএস ইনফোজোন প্রাইভেট লিমিটেডের। এটা মূলত ডেটা প্রসেসিং সংস্থা। বোর্ড অব ডিরেক্টর্সে রয়েছে দু’জন, ধৃত অয়ন শীল ও তার স্ত্রী কাকলি শীল। ইন্টারভিউ নেওয়া থেকে শুরু করে ওএমআর শিট ছাপানো, নিয়োগপত্র দেওয়া পর্যন্ত সব প্রক্রিয়ার জন্য টেন্ডার পেত এই অয়ন শীলের সংস্থা। এক প্রোমোটারের দু’টি সংস্থার মাধ্যমেই একদিকে পৌরসভায় নিয়োগ,অন্যদিকে পৌরসভার কাজের যাবতীয় বরাত।
এই অয়ন শীলের ঠিকানায় তল্লাশি চালিয়েই পাওয়া যায় একটি নোটবুক, সেখানেই পাওয়া যায় সুজিত বসুর নাম। দক্ষিণ দমদম পৌরসভায় অয়নের সংস্থার মাধ্যমে শুধু বেআইনি নিয়োগ নয়, বিপুল টাকার লেনদেনের তথ্যও মিলেছে। এদিন সকালে পৌর নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে সুজিত বসুর বাড়িতে হানা দেয় ইডি। এর আগেও পৌর নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তের সূত্রে সুজিতকে তলব করেছিল অন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। গত বছরের ৩১ আগস্ট তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা। সূত্রের খবর, পৌর নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে নেমে একাধিক জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে বেশ কিছু নথি উদ্ধার করা হয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, সেই নথির সূত্রেই সুজিতের বাড়িতে হানা দিয়েছে ইডি। ২০১৬ সালে দক্ষিণ দমদম পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন সুজিত। সেই সময় পৌর নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছিল বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। 
এদিন সকাল ৭টা নাগাদ মন্ত্রীর লেকটাউনের দু’টি বাড়িতে পৌঁছান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরা। মন্ত্রীর বাড়ি বাইরে থেকে ঘিরে ফেলে কেন্দ্রীয় বাহিনী। সন্দেশখালির ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে যথেষ্ট প্রস্তুত হয়েই যান তাঁরা। জওয়ানদের হাতে ঢাল, মাথায় হেলমেট। সুজিতের বাড়ির নিচেও মোতায়েন করা হয় পুলিশ। তল্লাশির মধ্যেই বিকেল নাগাদ সুজিতের ছেলে সমুদ্রকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ইডি’র অফিসাররা। সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা। তাঁকে নিয়ে শ্রীভূমি ক্লাবের উলটোদিকের একটি ফ্ল্যাটে যান ইডি’র আধিকারিকরা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই ফ্ল্যাটে সুজিতের একটি দপ্তর রয়েছে। সেখানে তিনি মাঝেমধ্যে গিয়ে বসেন। সেই দপ্তরে তল্লাশির পর সমুদ্রকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেই ফ্ল্যাটে, যেখানে ছিলেন তাঁর বাবা সুজিত। 
এদিন ইডি’র আধিকারিকরা বেরিয়ে গেলে লেকটাউনে নিজের পুরানো বাড়িতে যান সুজিত। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছেলে সমুদ্র বসুও। সাংবাদিকদের সুজিত জানান, তাঁর ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, যা তাঁর পক্ষে অসুবিধাজনক। কারণ দমকল মন্ত্রী হিসাবে জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত তিনি। তিনি এও জানিয়েছেন, ইডি অফিসারদের তিনি এবং তাঁর পরিবারের সবাই সহযোগিতা করেছেন। তারপরেই অস্বীকার করেছেন সব অভিযোগ। 
 

Comments :0

Login to leave a comment