দুর্নীতির অভিযোগে ধৃতরা কেন এসএসকেএম হাসপাতালে? বৃহস্পতিবার এই প্রশ্ন তুলল কলকাতা হাইকোর্ট। প্রভাবশালীরা কেন জেলে না থেকে সরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে আশ্রয় পাচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টি এস শিবজ্ঞানম। এদিন রাজ্য সরকারের কাছে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে প্রধান বিচারপতির ডিভিসন বেঞ্চ। রাজ্য সরকারকে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে, কতজন প্রভাবশালী এই হাসপাতালের আশ্রয়ে রয়েছেন। তাঁদের অসুস্থতা ঠিক কী রকমের? কত দিন তাঁদের চিকিৎসা চলছে? হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রভাবশালীরা কী কী সুবিধা পাচ্ছেন?
শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস-এর ডিরেক্টর সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’ গত সাড়ে চার মাস ধরে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। প্রধান বিচারপতির ডিভিসন বেঞ্চে এই নিয়েই একটি মামলা দায়ের হয়। মামলায় অভিযোগে জানানো হয়, সরকারি এই হাসপাতালটি বিভিন্ন দুর্নীতিতে ধৃত জেলবন্দিদের আশ্রয়স্থল হয়ে গিয়েছে। প্রভাবশালী এই অভিযুক্তদের হাসপাতালে রাখার কারণে বহু রোগী তাঁদের প্রাপ্য চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই ধরনের ব্যক্তিদের তদন্ত থেকে আড়াল করতে বিভিন্ন রকমের অপকৌশল গ্রহণ করছে, ফলে বহু মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বিষয়টিতে আদালতের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এদিন বিচারপতি শিবজ্ঞানম সরকারি আইনজীবীকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আপনারা প্রভাবশালীদের হাসপাতালে আশ্রয় দিচ্ছেন?’’ উত্তরে আইনজীবী বলেন, হাসপাতালে সবাইকেই চিকিৎসার জন্য আনা হয়। মামলাকারীদের আইনজীবী সুস্মিতা সাহা দত্ত আদালতকে জানান, রাজ্যের এই নামী হাসপাতালের পরিকাঠামো প্রভাবশালীদের পক্ষে কাজ করছে। এই বক্তব্যের পরই প্রধান বিচারপতি বলেন, এই অভিযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এই অভিযোগের উত্তর আদালতে দিতে হবে। মামলার শুনানিতেই উঠে আসে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর নাম। পার্থ চ্যাটার্জি, মদন মিত্র, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র সহ অনেককেই এই হাসপাতাল আশ্রয়ে রেখেছে। গত ২২ আগস্ট ‘কালীঘাটের কাকু’কে জেল থেকে এই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন থেকেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নানা অছিলায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের ‘কাকু’র কাছে যেতে দেয়নি। সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা হয়েছে চার বার। চিকিৎসকরা তাঁকে রক্ষা করেছেন। এমনকী শিশুদের জন্য তৈরি আইসিসিইউ’র বেডেও সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রকে শুইয়ে দিয়ে বেশ কয়েক দিন রাখা হয়েছিল। এদিন মামলাকারীর আইনজীবী আদালতকে জানান, বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় ধৃত প্রভাবশালীদের কেউ লাইফ সেভিং সিস্টেমের মধ্যে থাকেন না। তাঁরা হাসপাতালে অবাধে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু হাসপাতাল থেকে তাঁদের ছুটি দেওয়া হয় না।
বিচারপতি শিবজ্ঞানম সরকারি আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, এখানে কি জেল হাসাপাতালে চিকিৎসা হয় না? যাঁরা জেলে রয়েছেন, তাঁদের চিকিৎসা জেল হাসপাতালেই হওয়া দরকার। জেল হাসপাতাল রোগী রেফার করতে পারে। এইভাবে প্রভাবশালীদের চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসাপাতালে অনেক চিকিৎসককেও নিশ্চয়ই নিযুক্ত করতে হয়। এঁদের ছাড়া অন্য সাধারণ রোগীরা কীভাবে এই হাসপাতালে চিকিৎসা পেয়ে থাকেন, তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সরকারি হলফনামায় সমস্ত তথ্য থাকা প্রয়োজন। বিচারপতি সরকারি আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, এখন কতজন সেখানে আছেন? ১০ জন হবেন? এঁরা কী কী সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন? আগামী ২৪ জানুয়ারি মামলাটি পুনরায় শুনানির জন্য রাখা হয়েছে।
এদিন যখন এই হাসপাতালের মামলা নিয়ে প্রধান বিচারপতির ডিভিসন বেঞ্চে শুনানি চলছে, তখন বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসে ইডি’র আধিকারিকরা উপস্থিত হয়ে জানান, সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বিচারপতি সিনহা মামলাটি শুনানির জন্য ১০ জানুয়ারি রেখেছেন। আদালত নির্দেশ দিয়েছে, পরবর্তী শুনানির দিন অ্যাডভোকেট জেনারেলকে উপস্থিত থাকতে হবে। বুধবার বিচারপতির সিনহার এজলাসে শুনানি শেষ হওয়ার পরই ইডি’র আধিকারিকরা পৌঁছে গিয়েছিলেন এসএসকেএম হাসপাতালে। আদালতের নির্দেশ নিয়েই ইডি’র আধিকারিকরা অত্যাধুনিক অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসএসকেএম-এ গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে প্রথমে চিকিৎসকরা সুজয় ভদ্রের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এরপরই তাঁকে জোকা ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও চিকিৎসকরা তাঁকে পরীক্ষা করে দেখেন। এরপরই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করে। রাতেই ফের তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার ইডি আদালতকে জানিয়েছে, সুজয় ভদ্রের কণ্ঠস্বর ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে।
Comments :0