সত্যব্রত ভট্টাচার্য ও বিজন বিশ্বাস: কৃষ্ণনগর
মানুষের জীবনজীবিকার দুর্দশা ঘোচানোর কোনও বার্তা না দিয়ে কেবল ‘আমিত্ব প্রচার আর তৃণমূলকে দোষারোপে ভরিয়ে ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শনিবার কৃষ্ণনগরে এসে রাজ্যের মানুষের অপ্রাপ্তির জন্য মোদী কেবল মমতা ব্যানার্জির ঘাড়েই দায় ঠেললেন। তিনি বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রের স্কিমকে স্ক্যামে পরিণত করেছে এরাজ্যের তৃণমূল সরকার।’’ কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রকল্পের দুর্নীতি রোধে ব্যবস্থা না নিয়ে রাজ্যের মানুষের প্রাপ্য কেন আটকে চলেছেন সেই সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি মোদী।’’
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনাতে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে যাঁদের জড়ো করা হয়েছিল তাঁরাও হতাশ। নদীয়া জেলার জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে কিছু না বলেই ‘১৫ হাজার কোটি টাকার কিছু প্রকল্পের উদ্বোধনের দাবি করেছেন মোদী। আর রাজ্যের মানুষের অনুন্নয়নের জন্য তৃণমূলকে দায়ী করে বলেছেন, গরিব মানুষের টাকা তৃণমূল লুটে নিয়েছে। সব স্কিমকে স্ক্যামে বদলে দিচ্ছে। কেন্দ্রের প্রকল্পে স্টিকার লাগায় তৃণমূল। কমিশন না দিলে অনুমতি দেয় না, আগে কমিশন, তারপর পারমিশন।
সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম কলকাতায় এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘আবারও স্পষ্ট হয়ে গেল, প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর ঝগড়া কোন স্কিমে কার ছবি থাকবে সেটা নিয়ে। ওরা চায় মোদীর ছবি লাগাতে, এরা চায় দিদির ছবি লাগাতে। প্রকল্প রূপায়ণে নজর নেই , নামের জন্য ঝগড়া। কিন্তু রাজ্যের মানুষ কাম দেখতে চায়, নাম নয়।’ সেলিমের প্রশ্ন, ‘স্কিম নিয়ে দুজনের যদি এতই ঝগড়া তাহলে রাজভবনে বসে আগের দিনই খোশগল্প করে এলেন কেন? নিজেরা গল্প করবেন, আর মানুষকে ভাগ করবেন?’
কৃষ্ণনগরের ভাষণে মোদী বলেছেন, এরাজ্যের মানুষ কাঁদছে। এখানে পুলিশ নয়, অপরাধী ঠিক করে, কবে আত্মসমর্পণ করবে, কবে গ্রেপ্তার হবে।’ এই প্রসঙ্গে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘কেন্দ্রের মোদী সরকার, উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার, এরাজ্যের মমতা ব্যানার্জির সরকার নিজেদের পুলিশ এবং এজেন্সিগুলিকে ব্যবহার করছে দলীয় নেতানেত্রীদের নিরাপত্তার জন্য। আর এই নেতানেত্রীরাই অপরাধীদের আশ্রয় দিচ্ছে। মানুষ যখন অপরাধীদের শাস্তির জন্য লড়াই করছেন তখন তৃণমূল এবং বিজেপি প্রকাশ্যে ঝগড়া দেখাচ্ছে। আর ভিতরে ভিতরে অপরাধীরা যাতে ধরা না পড়ে। যেমন এক্ষেত্রে ভাইপো যাতে ধরা না পড়ে তার গ্যারান্টি দিচ্ছেন মোদী।’
সাধারণ মানুষ এমনকি তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভে মোদীর ভাষণ শুনতে আসা মানুষও এখন এই সারমর্ম বুঝতে পারছেন। তাই কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজের মাঠে এদিন দুপুরের কাঠফাটা রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনার পর নাকাশিপাড়ার বছর ষাটেকের বৃদ্ধ মধুসূদন দাস বললেন, কই আমাদের এখানকার সমস্যা নিয়ে কিছু তো শুনলাম না।’ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে কালিগঞ্জের গৃহবধূ মিতালী বিশ্বাস বলেছিলেন, যা শুনব বলে আশা করে এসেছিলাম তা হলো না। সারা দেশে সাফল্যের প্রচারই শুধু কানে এল।’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলা সফরের এটা ছিল দ্বিতীয় দিন। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজের গোটা মাঠ জুড়ে চরম অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর আগমন সঙ্গে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সীমান্তবর্তী জেলা নদীয়া জেলা, করিমপুর তেহট্ট চাপরা কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকাই সীমান্ত সংলগ্ন। এখানকার মানুষের নিত্যদিনের জীবন জীবিকার সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। একাধিক সমস্যা নিয়ে বহুবার স্থানীয় মানুষ প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েও সুরাহা পাননি। বিএসএফ’র কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে বহুবার বিষোদগার করতে দেখা গেছে। এদিন শ্রোতারা আশা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছু সুরাহার কথা বলবেন। কিন্তু মোদী সেপথে হাঁটেননি এদিন।
নদীয়া জেলায় ২৪ শতাংশেরও বেশি তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষের বাস। ইতিমধ্যেই সিএএ কার্যকর করার বার্তা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন প্রান্তিক মানুষজন। আধার কার্ড বাতিল নিয়েও মানুষের অভিযোগ বাড়ছে। বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর এদিন মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও প্রধানমন্ত্রী মানুষের আশঙ্কা ঘোচানোর জন্য একটি কথাও খরচ করেননি। তফসিলি মানুষের অধিকার প্রসঙ্গেও কোনও আশ্বাস দেননি। রেল পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর তরফে মানুষ কিছু সদর্থক আশা করেছিলেন। কৃষ্ণনগর –করিমপুর রেলপথ তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু তৃণমূল ও বিজেপি— উভয়ের পক্ষ থেকে মিলেছে শুধুই প্রতিশ্রুতি আর টালবাহানা। প্রকল্প এখনও অথৈ জলে। করিমপুর তেহট্ট চাপড়া এলাকা জুড়ে একসময়ে কৃষির যে বিকাশ হয়েছিল, তা মার খেয়ে গেল এই রেলপথ না হওয়ার কারণে। প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প নিয়ে কিছু না বলায় স্বাভাবিকভাবেই হতাশ হয়েছেন কৃষকরা। তবে ক্ষতে প্রলেপ দিতে স্বাস্থ্যবিমা, এইমস, বিনামূল্যে রেশনের প্রসঙ্গ টেনে এনে এদিন প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কিষানদের এখন সম্মান মিলছে!’
কেন্দ্রের উদ্যোগে কোনও শিল্প কলকারখানা স্থাপনের কথাও বলেননি তিনি। পলাশির একশো বছরের পুরানো পলাশির চিনি কল বন্ধ, বহু মানুষের কাজ চলে গেছে, হাজার হাজার একর জমি লুট হয়ে গেছে। ধুঁকছে কল্যাণী শিল্পাঞ্চল। আর প্রধানমন্ত্রী ২২ হাজার কোটি টাকার বিকাশ প্রকল্পের গল্প বলে যুবদের কর্মসংস্থানের সুযোগের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
Comments :0