মণ্ডা মিঠাই | নতুনপাতা
সহজপাঠ ও শিল্পী নন্দলাল বসু
সৌম্যদীপ জানা
নতুন বন্ধু
আমরা সকলেই ছেলেবেলায় মায়ের কাছে অক্ষরজ্ঞানের পরে প্রথম যে দুটি বই থেকে বাংলা ভাষার জ্ঞান পাই সেই দুটি বই হল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “বর্ণপরিচয়"ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “সহজপাঠ"। আপামর বাংলা ও বাঙালির ছেলেবেলা এই দুটি বই ছাড়া অসম্পূর্ণ। এদের মধ্যে সহজ পাঠ বইটি আমাদের কাছে অতি পরিচিত। কবিগুরুর লেখা সেই লাইনগুলি আজও যেন আমাদের কানে বাজে আর মনে হয় আবার সবাই পিছনে ফিরে গিয়ে ছেলেবেলায় পৌঁছে যাই!
কিন্তু এই সহজপাঠ বইয়ের মধ্যে থাকা চিত্তাকর্ষক ছবিগুলি এবং তার পিছনের অক্লান্ত পরিশ্রম ও পরিকল্পনার কথা আমরা অনেকেই জানিনা!
নন্দলাল বসু ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিত্রশিল্পী। কবিগুরুর আহবানে নন্দলাল বাবু শান্তিনিকেতন এবং শ্রীনিকেতনের চিত্রসজ্জার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে
শান্তিনিকেতনের চিত্রশিল্প বিভাগের শিক্ষক হয়েছিলেন। অত্যন্ত প্রতিভাবান নন্দলাল বসুকে কবিগুরু দায়িত্ব দিয়েছিলেন শিশুদের জন্য তাঁর লেখা বাংলা ভাষা শিক্ষার বই “সহজ পাঠ"এর চিত্র সজ্জা এবং অলংকরণের। নন্দলাল বসু ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং মেধাবী শিল্পী। তিনি বুঝেছিলেন যে শিশুদের জন্য রচিত বইয়ে শিশু মনের উপযোগী ছবি প্রযোজ্য। তিনি ঠিক করলেন সহজ পাঠের ছবিগুলি তিনি অসম্পূর্ণ রাখবেন অর্থাৎ সম্পূর্ণ রং করবেন না, কিছুটা বাকি রাখবেন এবং সেই বাকি অংশটুকু শিশুরা নিজের কল্পনা দিয়ে ভরাট করে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রথম ধাপে এক ধাপ অগ্রসর হয়ে যাবে।
সহজ পাঠ বইয়ে নন্দলাল বসুর আঁকার ধরণ ছিল বেশ ভিন্ন। তিনি প্রত্যেকটি ছবি আলাদাভাবে পরিকল্পনা করে বিশেষ বিশেষ কয়েকটি জায়গায় রং করেন নি। তাছাড়া ছবিগুলিতে তিনি অনেক শিশুসুলভ ভুল ও করেছিলেন কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে শিশুদের জন্য রচিত বইতে যদি সম্পূর্ণ সঠিক চিত্র তুলে ধরা হয় তবে ইসুড়া বইয়ের ছবি দেখে আগ্রহী হবে না। কারন শিশুদের জন্য লেখা বইয়ে ছবি হওয়া উচিত শিশুসুলভ ই।
তাঁর আঁকা বেশ কয়েকটি ছবির বৈশিষ্ট্য হল:-
★ ছোট খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া
সহজ পাঠ বইয়ের একদম প্রথম ছবি হলো এটি। এই ছবিটিতে নন্দলাল বসু দেখিয়েছেন যে একটি ছোট শিশু হামাগুড়ি দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। সম্পূর্ণ পেন্সিল স্কেচ করাই ছবিটি বেশ চিত্তাকর্ষক। এই ছবিটিতে শুধু শিশুটির গায়েই রং করা হয়েছে বাকি ছবিটি হালকা পেন্সিল স্ট্রোকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
★ বনে থাকে বাঘ গাছে, থাকে পাখি
ছোটবেলার সেই বিখ্যাত লাইন- বনে থাকে বাঘ, গাছে থেকে পাখি। এই কবিতাটির জন্য নন্দলাল বসু একটি পেন্সিল স্কেচ করেছিলেন যাতে তিনি দেখান যে একটি বনের মধ্যে গায়ের চাকা চাকা ছোপ দেওয়া বাঘ বসে আছে, তার পাশে পেন্সিলের টানে ফুটিয়ে তোলা গাছ পাখি ইত্যাদি চিত্র যা দেখে শিশুরা উৎসাহিত হয় আঁকার ইচ্ছে প্রকাশ করে।
★ কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি
আমাদের অতি পরিচিত কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি কবিতাটির জন্য নন্দলাল বসু সহজ পাঠিয়ে যে ছবিটি একেছিলেন সেটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। তিনি এঁকেছিলেন, একটি হাটের ছবি যেখানে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একটি হাটে গোটা রাজ্যের লোক তাদের রুজির জন্য পসরা সাজিয়ে বসে এবং বেচাকেনা করে।
“ একদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখিনু "
এই কবিতাটির জন্য নন্দলাল বাবু যে ছবিটা আঁকেন তা অত্যন্ত জটিল হলেও আপাত দৃষ্টিতে বেশ সোজা। তিনি লিখেছেন দেখছি রাস্তায় অজগর তুল্য ট্রাম গাড়ি কিভাবে এঁকেবেঁকে যায় আর শহর কলকাতার ব্যস্ত জীবনের কোলাহল মুখরিত পরিবেশ। তিনি এই ছবিটা আরো দেখিয়েছেন যে কিভাবে কলকাতার ব্যস্ত যেন জীবনের মাধ্যমে কত মানুষের জীবনের কত রকমের অসুবিধা সৃষ্টি হয়। এই ছবিটি থেকে শিশুর া সামাজিক জ্ঞান লাভ করতে পারে।
অঞ্জনা নদীর তীরে চন্দনী গায়
এই কবিতায় নন্দলাল বসুর আঁকা ছবিটি বেশ সরল কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে আছে গভীর এক তাৎপর্য। তিনি একটি ভাঙ্গা নৌকার ছবি এঁকেছেন এবং তার চারের পাশে ঝোপ ঝাড় সমৃদ্ধ মজে যাওয়া একটি নদীর দৃশ্য। এই ছবির মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে কিভাবে দিন দিন আমরা আধুনিকতার পাল্লায় পড়ে আমাদের সংস্কৃতির কথা ভুলে যাচ্ছি। প্রাচীন গ্রামের বড় মন্দির যেখানে একসময় আড়ম্বরের সঙ্গে পুজো হতো তা আজ পরিণত হয়েছে পরিতক্ত মন্দিরে। তাছাড়া এই কবিতাটির প্রতিটি লাইনে কবি গুলির ভাব গুলি নন্দলাল বাবু তার ছবির সাহায্যে হুবহু তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
নবম শ্রেণী
কল্যাণ নগর বিদ্যাপীঠ খড়দহ উত্তর ২৪ পরগনা
Comments :0