গল্প | নতুনপাতা
ভক্ত
সৌরীশ মিশ্র
"উনি তো চলে গেছেন। পাঁচটা অবধি ছিলেন এখানে।"
স্টলের ক্যাশ কাউন্টারে বসা বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথাগুলো শুনেই মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল রায়া-র। কতো আশা করে এসেছিল ও। সব আশায় যেন ওর, জল ঢেলে দিল কেউ।
বইমেলায় এসছে রায়া ওর বাবা-মা'র সাথে। প্রতিবছরই আসে। তবে, বইমেলায় শুধু ঘুরতে আসে না সে। বই-ও কেনে বেশ কয়েকটা পছন্দ করে-করে। বই যে ওকে টানে খুব। রায়া-র বাবা-মা-ও তাঁদের মেয়ের এই বই কেনা, বই পড়ার ব্যাপারটায় উৎসাহ দেন। তাঁরা দু'জনই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, বই-এর মতোন বন্ধু হয় না।
তবে, রায়া, আজ, ওর পছন্দসই বই কেনা ছাড়াও আর একটা ইচ্ছা নিয়েও এসেছিল বইমেলায়। এই মুহূর্তে যে স্টলে ওরা আছে, সেখানেই দুপুর তিনটে থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি থাকার কথা ছিল রায়া-র প্রিয় লেখিকা চন্দ্রিমা চক্রবর্তীর। আজকেরই খবরের কাগজের একটি বিজ্ঞাপনে পেয়েছিল রায়া খবরটা। রায়া-র ইচ্ছা ছিল তার প্রিয় সাহিত্যিকের সদ্য প্রকাশিত বইটা কিনে তাতে সই করাবে সে। এ কথা বাবা-মাকে বলেওছিল ও। সেই মতোই রায়ারা বেড়িয়েছিল বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা সময় হাতে নিয়েই। কিন্তু, কে জানত, ট্রেন অবরোধের জেড়ে ওদের বইমেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছতে এতোটাই দেরী হবে যে পাঁচটাও বেজে যাবে!
"এতো দেরী করলেন কেন?" ফের বললেন রায়া-র বাবাকে স্টলের সেই ক্যাশে বসা বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
"ট্রেন অবরোধের জন্যই তো ট্রেনে বসে থাকতে হোলো দু'ঘন্টারও বেশী।"
"ও। মেয়ের প্রিয় না কি চন্দ্রিমাদি?"
"হ্যাঁ।"
"বুঝতেই পেরেছি। উনি চলে গেছেন শুনেই মেয়ের মুখ তাই কালো হয়ে গেল সাথে সাথে।"
"হুঁ" রায়া-র বাবা মেয়ের মাথায় আলতো করে স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন।
"আমার স্টলে এসে ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। দাঁড়ান দেখি, কিছু করা যায় নাকি। আমারও তো বাড়িতে ঠিক ওরই বয়সী একটি নাতনি আছে। আমি ফিল করতে পারছি পুরো, ওর কষ্টটা। দেখি একটা ট্রাই করি, চন্দ্রিমাদিকে ফোনে ধরার। মেলা মাঠে এখনও উনি থাকলে, ওকে চন্দ্রিমাদির সাথে দেখা করাতে তেমন অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। চন্দ্রিমাদি যথেষ্ট ভাল মানুষ..." বলতে বলতেই পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলেন ভদ্রলোক। তারপর ফোন লাগালেন একটা।
" হ্যালো, হ্যালো, চন্দ্রিমাদি?... আপনি কি মেলাতেই আছেন?... আসলে, আপনার এক খুদে ভক্ত আমার স্টলে এসে বসে আছে। ওর একটু দেরী হয়ে গেছে আসতে। বুঝতেই পারছেন, আপনার দেখা না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে বাচ্চা মেয়েটার। আশা করে এসেছিল তো। তাই বলছিলাম, যদি সম্ভব হয়... আচ্ছা, ঠিক আছে দিদি..." মোবাইল ফোনটা কান থেকে নামান ভদ্রলোক। তারপর, কলটা কেটে, ফোনটা পাঞ্জাবির পকেটে রাখেন সেটা ফের।
এতক্ষণ রায়া আর ওর বাবা-মা তিনজনই একবুক উৎকণ্ঠা নিয়ে ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে শুনছিল এই একদিকের ফোনালাপ। আর, আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল, ও তরফ থেকে বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক চন্দ্রিমা চক্রবর্তী ঠিক কি বলছেন ঐ ভদ্রলোককে।
ফোনটা ভদ্রলোক পকেটে রাখা মাত্রই আর তার উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারল না রায়া। সে বলেই বসল ভদ্রলোককে, "কি বললেন গো?"
বৃদ্ধ এবার সোজা তাকালেন রায়া-র দিকে। "কি বললেন? বললেন, উনি আসছেন একটু বাদেই। আশেপাশেই আছেন। তোমাকে এখানে অপেক্ষা করতে বলেছেন।" ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।
"রায়া, প্রণাম কর দাদুকে। তোমাকে এতো বড় একটা সুযোগ করে দিলেন উনিই কিন্তু। যাও যাও, প্রণাম কর।" সাথে সাথেই মেয়েকে বলে উঠলেন রায়া-র বাবা।
রায়া এগিয়ে গিয়ে পা ছোঁয় বৃদ্ধের।
ভদ্রলোক রায়া-র মাথায় আশীর্বাদের হাত রাখেন। বলেন, "অনেক বড় হও দিদিভাই।"
ঠিক তখনই, ঐ স্টলে এসে ঢুকলেন চন্দ্রিমা চক্রবর্তী।
আর ঢুকেই, সামনেই ক্যাশে বসা ভদ্রলোককে দেখে বললেন, "অজিতবাবু, কই আমার সেই ভক্ত? ও, এই বুঝি?" রায়া-র দিকে তাকিয়ে শেষ কথাটা বলেন চন্দ্রিমা চক্রবর্তী।
"হ্যাঁ, দিদি। এই।" চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন বৃদ্ধ।
রায়া-র তখন এইসব কথা একটিও কানে যাচ্ছে না। সে তখন দেখেই চলেছে চন্দ্রিমা চক্রবর্তীকে। দেখবে না! রায়া যে দেখছে তার প্রিয় লেখিকাকে সামনাসামনি এই প্রথমবার।
Comments :0