baharampur farmers death

বহরমপুরে কৃষকের মৃত্যু পুলিশের টিয়ার গ্যাসে

জেলা

 বহরমপুর শহরে বামপন্থী শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের উপরে মমতা ব্যানার্জির পুলিশের নৃশংস আক্রমণে নিহত হলেন ডোমকলের কমরেড আনারুল ইসলাম। ৫৩ বছরের কমরেড আনারুল মঙ্গলবার বহরমপুরে পুলিশের টিয়ার গ্যাসে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে‍‌ছিলেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি প্রাণ হারান।   
মঙ্গলবার আইন অমান্য কর্মসূচীতে বহরমপুরের টেক্সটাইল মোড়ে অংশগ্রহণকারীরা পুলিশের ব্যারিকেডের কাছে পৌঁছাতেই পুলিশ মারমুখী হয়ে ওঠে। মমতার পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি এবং কাঁদানে গ্যাস চালায় আন্দোলনকারীদের উপরে। পুলিশের বেধড়ক মারে, বুটের লাথি এবং লাঠির আঘাতে, পুলিশের ছোঁড়া ইটের ঘায়ে ষাট জনের বেশি আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৬ জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ৭ জন মহিলা সহ ২৩ জন আন্দোলনকারীকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়, পরে মহিলাদের ছেড়ে দিলেও ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে বহরমপুর থানায় আটকে রাখে। 
ডোমকলের সারাংপুর অঞ্চলের সাহাবাজপুর গ্রামের বাসিন্দা রজব আলির ছেলে কমরেড আনারুল ইসলাম এদিন পুলিশের টিয়ার গ্যােসে অসুস্থ হলে তাঁকে প্রথমে ইসলামপুর হাসপাতালের ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থা গুরুতর হলে ডোমকল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে তাঁকে রেফার করা হয় বহরমপুরে। রাস্তায় বালিরঘাটের কাছে তাঁর মৃত্যু হয়। 
সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বহরমপুরে এই আইন অমান্য কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছিলেন। পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা করে তিনি বলেছেন, ঘোষিত আইন অমান্য কর্মসূচী সত্ত্বেও প্রশাসন কোনও ম্যাজিস্ট্রেটকে উপস্থিত রাখেনি। কেবল মারের জন্য পুলিশকে রাখা হয়েছিল। কোনও আইন মানেনি পুলিশ। শহীদ কমরেড আনারুল ইসলামের মৃত্যুতে গভীর শোক এবং তৃণমূল সরকারের পুলিশের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেছেন, মোদী সরকারের পুলিশ কৃষকদের দিল্লি অভিযানে লাঠি চালাচ্ছে, আর এখানে মমতা সরকারের পুলিশও একইভাবে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের উপর লাঠি, কাঁদানে গ্যাস চালাচ্ছে। মহম্মদ সেলিম এই পুলিশী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা রাজ্য ধিক্কার কর্মসূচির আহ্বান জানিয়েছেন। 
এদিন সেলিম আরও বলেছেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকার মনে করেছে, পুলিশ দিয়ে মানুষের প্রতিবাদ বন্ধ করবে। সরকারের সব দপ্তর তুলে দিয়ে শুধু পুলিশ দপ্তর রাখুক। মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সভা, কার্নিভাল, সার্কাস, তামাশা করতে গেলে পুলিশ সুপার, জেলাশাসক মিলে কার্পেট বেঁধে লোকজন জড়ো করার দায়িত্ব নেন। এখানে মানুষ প্রতীকি আইন অমান্য করছেন। কারণ, কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার আইন অনুসারে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের অধিকার দিচ্ছে না। পুলিশের কাজ চোর ধরা, কিন্তু রাজ্য জুড়ে পুলিশ চোরদের পাহারা দিচ্ছে। সন্দেশখালিতে পুলিশের ধরার কথা কাকে? যারা মা-বোনেদের ইজ্জত নিচ্ছে, জমি-ভেড়ি-চর দখল করেছে। পুলিশ যদি বন্দুক হাতে চোরেদের পাহারা দেয়, তাহলে মানুষ ঝাঁটা হাতে চোরকেও তাড়াবে, পুলিশকেও তাড়াবে। 
এদিন পূর্ব ঘোষণা মতোই বহরমপুরে আইন অমান্য অভিযানের ডাক দিয়েছিল সারা ভারত কৃষক সভা, খেতমজুর ইউনিয়ন, সিআইটিইউ সহ বামপন্থী সংগঠনগুলি। জেলাশাসকের অফিসের থেকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে টেক্সটাইল মোড়েই ব্যারিকেড বসিয়েছিল পুলিশ। একদিকে পুরানো কালেক্টরেট মোড়, অন্যদিকে টেক্সটাইল মোড়, সকাল থেকেই দু’দিকেই ছিল পুলিশের পাহারা। পঞ্চাননতলা, বহরমপুর স্টেশন আর  উত্তরপাড়া থেকে শুরু হয়ে তিনটি মিছিল টেক্সটাইল মোড়ে এসে পৌঁছালে প্রথমে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মহম্মদ সেলিম ছাড়াও বক্তব্য রাখেন কৃষক সভার জেলা সম্পাদক আবু বাক্কার, খেতমজুর ইউনিয়নের জেলা সম্পাদক জামাল হোসেন, সিআইটিইউ জেলা সম্পাদক জ্যোতিরূপ ব্যানার্জি। সভাপতিত্ব করেন সচ্চিদানন্দ কাণ্ডারি। প্রায় হাজার দশেক মানুষের জমায়েত হয়েছিল। ভাষণ শেষে আইন অমান্য কর্মসূচীতে মহিলাদের ও নেতৃবৃন্দকে সামনে রেখে লাল ঝাণ্ডা হাতে মিছিল শুরু হতেই রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় টেক্সটাইল মোড়। মাথায় হেলমেট এবং শরীর জুড়ে গার্ড লাগানো লাঠি হাতে পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনকারীদের উপরে। মুহূর্মুহূ টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটায় পুলিশ। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের ঘিরে মাটিতে ফেলে পুলিশ বেধড়ক মারতেও থাকে। দূরে ছিটকে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে ইট-পাথর ছুঁড়তে দেখা যায় পুলিশকেই। গ্রামাঞ্চল থেকে আসা গরিব ও বয়স্ক মানুষ, মহিলা কেউ রেহাই পাননি পুলিশের নির্মম মার থেকে। এর ফলে বহু আন্দোলনকারী জখম হয়েছেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ কোনও অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও রাখেনি। প্রায় অচেতন কয়েক জনকে পুলিশের গাড়িতে তুলেই নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
আইন অমান্যের মিছিলের আগে সভায় মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘আমরা আইনের শাসন চাইছি, যেটা এখন নেই। পুলিশ প্রশাসন চোরদের চুরিতে, ভোট লুটেরাদের ভোট লুটে সাহায্য করছে, দুর্নীতিগ্রস্তদের পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। সন্দেশখালি দেখাচ্ছে, গ্রাম জাগছে, মা-বোনেরা সেখানে আক্রান্ত, তাঁরাই সবার আগে জেগেছেন। জনরোষে তৃণমূলের মন্ত্রী-নেতারা লুকিয়ে বেড়াচ্ছে, আর সামনে পুলিশকে এগিয়ে দিচ্ছে। ইডি মার খেলো, কিন্তু পুলিশ আজ পর্যন্ত ধরলো না শাহজাহানকে।’’ 
রাজ্যে লুট-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনও রাজভবন, বিজেপি, কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে ভরসা না রেখে মানুষকে একজোট হতে বলেছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, ‘‘গোটা রাজ্যে আমরা তৃণমূলকে খালি করে দিতে পারতাম, কিন্তু বিজেপি ঢুকে রাজ্যের মানুষকে ধর্মের নামে ভাগ করতে লেগেছে। অনেক প্রচার করেছিল, এবার ভাইপোকে ডাকবে, তারপর পিসিকে ডাকবে। কাউকে ডাকছে না, ভাইপোর সঙ্গে তলে তলে বোঝাপড়া হয়ে গেছে। এখন শাহজাহানের ধর্ম দেখিয়ে হিন্দু-মুসলিমে ঝগড়া লাগাতে চাইছে। চুরির সময়ে শাহজাহান, শিবু আর উত্তম একজোট। আর চোর ধরার বেলা ধর্ম দেখিয়ে ভাগাভাগি?’’
তিনি বলেন, মমতা ব্যানার্জির পুলিশ শিবু হাজরার থেকে টাইপ করা অভিযোগ লিখিয়ে নিরাপদ সর্দারকে গ্রেপ্তার করেছে মিথ্যা অভিযোগে। তৃণমূলী উত্তমকে অতি উত্তম বলে জামিনে রাজি হয়ে গরিবের পাশে দাঁড়ানো নিরাপদকে বিপজ্জনক বলে আটকে রেখেছে পুলিশ। হাইকোর্টে ওই পুলিশকে তুলে নাকখত দেওয়ানো হবে।
সেলিম বলেছেন, মমতা ব্যানার্জি বামপন্থীদের আন্দোলনের ভয়ে সরস্বতী পুজোর একদিন আগেই ছুটি করে দিয়েছেন সরকারি অফিস। কিন্তু ছুটি করে পার পাবেন না। বামপন্থীদের আন্দোলন-সংগ্রামে কোনও ছুটি নেই। এত মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। হক আদায় করতে হবে, তার জন্য ধক তৈরি করতে হয়। সাজানো বিরোধী বিজেপি’র দ্বারা সেটা হবে না। বাংলার মাটিতে ন্যায় আদায় করতে গেলে, মোদীর লুট হোক, আর দিদির লুট হোক, দুটোই বন্ধ করতে হলে মানুষকে এককাট্টা করতে হবে। একা একা চোর তাড়ানো যায় না। 
এদিনের কর্মসূচী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে খেতমজুর ইউনিয়নের জেলা সম্পাদক জামাল হোসেন, ডিওয়াইএফআই’র জেলা সম্পাদক সন্দীপন দাস, ডিওয়াইএফআই’র জেলা সভাপতি সৈয়দ নুরুল হাসান এবং সংগঠনের নেতা শাহনাওয়াজ ইসলামকে। পুলিশি হামলার নিন্দা করে সিপিআই(এম)’র মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা বলেছেন, সাধারণ মানুষে উপর নৃশংস হামলায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, তৃণমূলের নির্দেশে পুলিশ চলছে। এর প্রতিবাদে সমস্ত অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
বহরমপুরে পুলিশের ভূমিকার নিন্দা করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেছেন, এই সরকার স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে চলছে। তবে এভাবে বিরোধীদের আন্দোলন থামানো যাবে না। কংগ্রেসের কর্মসূচীর উপরে পুলিশী হামলার প্রতিবাদেও সরব হয়েছেন অধীর চৌধুরী। তিনি বলেছেন, শান্তিপূর্ণ আইন অমান্যে পুলিশের তো বাহাদুরি দেখানোর কিছু নেই! পুলিশ সন্দেশখালিতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে বাহাদুরি দেখাক।
পুলিশী হামলার নিন্দা করেছে এপিডিআর’র বহরমপুর শাখাও। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজ্যের অন্যান্য এলাকার মতো মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরও কি পুলিশি শাসনের শহর হয়ে উঠলো?

 

Comments :0

Login to leave a comment