বই
ফিদেল কাস্ত্রো
প্রদোষকুমার বাগচী
মুক্তধারা
প্রায় ১৫০০০ কিমি দূরে বসে আজও কিউবাকে, কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেলকে জানার আগ্রহের শেষ নেই। এই আগ্রহ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় বামপন্থীদের সঙ্গে বাম বিরোধী মানুষেরও সমান। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার একশো
ভাগের এক ভাগ আয়তন বিশিষ্ট কিউবা কোন শক্তির জোরে নাকের ডগার দূরত্বে থেকেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ‘নাকমে দম’ করে দিতে পারে? সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এবং কিউবার ওপর আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ
সত্বেও কোন উপায়ে ফিদেলের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক সংকট থেকে কিউবা মুক্তি পেয়েছিল? শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখি হার পশ্চিম গোলার্ধের সমস্ত দেশের মধ্যে কিউবাতে সর্বোচ্চ। কিভাবে সম্ভব? শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজার জনে ৬০
এই সবের সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তীর বই ‘‘ফিদেল কাস্ত্রো : বিপ্লবের অন্য ইতিহাস’’। অসম্ভব সুন্দর বইটি। বামপন্থী, মার্কসবাদী, কমিউনিস্ট, এই সব শব্দগুলি শুনলে যে সব তথাকথিত
বুদ্ধিজীবীদের গা রীরী দিয়ে ওঠে, সেই সব ভদ্রসমাজের প্রচারে ‘‘বামপন্থী, কমিউনিস্টরা চরম অগণতান্ত্রিক’’। রাজকুমার চক্রবর্তী তথ্য দিয়ে বইটিতে লিখেছেন ‘‘শ্রমনীতি সংক্রান্ত যেকোনও বিষয়ে পরিবর্তন আনতে গেলে শমিক
ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে ও তাদের সম্মতি নিতে কিউবা সরকার বাধ্য(এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ভারতের সঙ্গে ‘‘অগণতান্ত্রিক’’ কিউবার তুলনা করুন)।’’
কিছু ধার্মিক বুদ্ধিজীবী (অবশ্যই নেপথ্যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদে রঅর্থ) প্রচার কের বেড়ায় ‘‘কমিউনিস্টরা ধর্মবিদ্বেষী।’’ বইটির ‘‘কাস্ত্রো ধর্ম বিপ্লব’’ অধ্যায়টি অবশ্য অন্য কথা বলে। এই অধ্যায়ে কাস্ত্রোর ২৬জুলাই আন্দোলন এ
ধর্মবিরোধিতার কোনও লক্ষণ ছিল না। কৃষক গেরিলা যোদ্ধাদের বেশিরভাগই ছিলেন দীক্ষিত খ্রিষ্টান। এমনকি কাস্ত্রোর গেরিলা বাহিনীর একজন ক্যাথলিক যাজকও ছিলেন যিনি পরে কমানদান্তে বা সেনধ্যক্ষ পদেও উন্নীত হয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিকতাবাদ অধ্যায়ে দুটি লাইনে যে তথ্য লেখক দিয়েছেন তাতে বরং মিথ্যা প্রচারের উলটোটাই প্রমাণ হয়। সেই তথ্য অনুযায়ী ‘‘শুধু আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিক নয়, কিউবার সেনারা মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ার ডাক ছুটে গেছে,
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ইজরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে গোলান গিশিখর রক্ষা করেছে।’’ কিউবা শুধু কিউবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে মুক্ত করতে সমগ্র লাতিন আমেরিকা এমনি আফ্রিকাতে কিউবা তার
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। নেতৃত্বে ফিদেল। দুই হাজারের বেশি কিউবান আন্তর্জাতিক যোদ্ধা দেশের বাইরে শহীদ হয়েছে অন্য জাতিগুলির স্বাধীনতার জন্য
যারা কমিউনিস্টদের সন্ত্রাসবাদী প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর ( সোস্যালিস্ট ভগৎ সিং কেও যারা সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেয়) বইটি তাদের অন্তত একবার পড়া দরকার। ডায়ান যয়িলেকার গবেষণামূলক বই ‘‘ফিসেলস এথিক্স অভ
ভায়োলেন্স’’ এর ওপর ভিত্তি করে লেখক দেখিয়েছেন বাতিস্তার বন্দি সেনাদের প্রতি কাস্ত্রো কখনও দুর্ব্যবহার করেন নি। বরং বন্দি সেনাদের চিঠি তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে যেত ফিদেলের নির্দেশে। ফিদেল কাস্ত্রোর লড়াই মূলত
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, আমেরিকার মানুষরে বিরুদ্ধে নয়। তাই ‘‘২০০৫ এ হ্যারিকেন (ক্যাটরিনা) ঝড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অর্লিয়েন্স প্রদেশ যখন বিপর্যস্ত হলে যায় তখনও ১৬১০ জন কিউবান ডাক্তারক সেখানে পাঠানোর
প্রস্তাব দিয়েছিল কিউবা সরকার।’’
মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সঙ্গে হোসে মার্তির আদর্শের সংমিশ্রণ এবং কিউবার বিশেষ সমাজ-বাস্তবতা কিউবার বিপ্লবকে অনন্য চরিত্র দিয়েছে। রুশ বিপ্লব এবং চিনের বিপ্লবের থেকে এখানকার বিপ্লব নানা দিক থেকে স্বতন্ত্র সেই
স্বাতন্ত্র্যের চর্চা আমাদের দেশে খুব একটা হয় নি। এই বই কিউবার বিপ্লবী অনুশীলনের অনন্যতার উপর আলোকপাত করেছে।
তথ্যযুক্ত বইটিতে ফিদেল-এর বিপ্লবী জীবন, বিপ্লবী চিন্তাভাবনার বিবর্তন খুব সুন্দরভাবে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। সঙ্গে লেখকের রচনাশৈলী অতুলনীয়। পড়তে পড়তে মনে হবে ঘটনাগুলো যেনো চোখের সামনে ফুটে উঠছে।
এখানেই লেখকের সার্থকতা। বইটি গ্রন্থাগারে রাখলে অনেক পাঠকের কাজে লাগবে।
ফিদেল কাস্ত্রো : বিপ্লবের অন্য ইতিহাস
রাজকুমার চক্রবর্তী। অনুষ্টুপ। ২নবীন কুণ্ডু লেন। কলকাতা-৯। ২৫০ টাকা।
Comments :0