টাটা গোষ্ঠীকে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া করার পর ক্ষমতার বদল ঘটেছে রাজ্যে। যারা সেসময় টাটাকে রাজ্য ছাড়া করেছিল তারাই এখন শাসন ক্ষমতায়। তবে ক্ষমতা বদলের পর বিভিন্ন শিল্পের রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার ‘ট্র্যাডিশন’ সমানে চলেছে। গত ৩ ডিসেম্বর সংসদে প্রশ্নের লিখিত জবাবে শিল্পের রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার যে তথ্য পেশ করা হয়েছে তাতে শিল্প চলে যাওয়ার হার বৃদ্ধি প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। শিল্পের উৎপাদন খরচ, পরিকাঠামোগত সমস্যা, আইন শৃঙ্খলার সমস্যা শিল্পের রাজ্যত্যাগের অন্যতম কারণ বলে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, নতুন শিল্প বা স্টার্ট আপ কোম্পানির সংখ্যাও অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে কমেছে।
সংসদে মন্ত্রীর লিখিত জবাবে দেখা গিয়েছে, নতুন শিল্পে ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে রাজ্য। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সঞ্জীব সান্যাল তার রিপোর্টে জানিয়েছে অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি পিছিয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ। তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৬০-৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু এবং মহারাষ্ট্র ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সব থেকে এগিয়ে থাকা রাজ্য। মহারাষ্ট্র তার আর্থিক বৃদ্ধির হার ধরে রাখতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গ তা পারেনি। ক্রমশ পিছিয়ে গেছে অর্থনীতিতে। জমানা বদলের পর ঢাকঢোল পিটয়ে বহু শিল্প বাণিজ্য মেলা হলেও শিল্পের ক্ষয়ে যাওয়া চিত্রে কোনও বদল আসেনি।
কেন্দ্রের কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল, পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কতগুলি কোম্পানি তাদের দপ্তর তুলে নিয়ে অন্য রাজ্যে চলে গিয়েছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসর পরের সময়ে শিল্পের রাজ্যত্যাগের হিসাব চাওয়া হয়েছে। জবাবে মন্ত্রী হর্ষ মালহোত্রা জানাচ্ছেন, ওই সময়ে মোট ২ হাজার ২২৭টি কোম্পানি তাদের রেজিস্টার্ড অফিস রাজ্য থেকে তুলে অন্য রাজ্যে নিয়ে গিয়েছে। এই ২২২৭টি কোম্পানির মধ্যে ৩৯টি কোম্পানি হলো কোম্পানি আইনে তালিকাবদ্ধ বড় কোম্পানি। এই কোম্পানিগুলি মূলত উৎপাদন শিল্প, বাণিজ্য, কমিশন এজেন্ট, আর্থিক পরিষেবা ক্ষেত্রে যুক্ত। মন্ত্রী জানান, কোম্পানি আইনের ৩০ নম্বর বিধি মতোই তাদের রাজ্যত্যাগ করে অন্য রাজ্যে স্থানান্তরিত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন ছিল, কোম্পানিগুলি কি রাজ্যে শিল্প বাণিজ্য চালানোর ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হওয়ার কারণে রাজ্য ছেড়েছে? মন্ত্রী জবাবে জানাচ্ছেন, তারা রাজ্য ছাড়ার আবেদনপত্রে যে কারণগুলি জানিয়েছে তাতে রয়েছে শিল্পে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, প্রশাসনিক সমস্যা, যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা, আইন শৃঙ্খলার সমস্যার কথা। ক্ষমতা বদলে শাসক রাজ্যে শিল্পে জোয়ার আনার দাবি করলেও সেই জোয়ার তো আসেনি। উলটে রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ায় শিল্পে ভাটার টান দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, তথ্যপ্রযুক্তি সহ বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি সংক্রান্ত ছোট শিল্পের বিকাশে মোদী সরকার ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি স্টার্ট আপ প্রকল্প ঘোষণা করে। শিল্পে আর্থিক সহায়তার ১০ হাজার কোটি টাকা তহবিলের কথা ঘোষণা করা হয়। মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল, বিভিন্ন রাজ্যে ২০২২ এবং ২০২৩ সালে কত স্টার্ট আপ নতুন শিল্প গড়ে উঠেছে? জবাবে স্টার্ট আপ সংক্রান্ত নতুন শিল্পের যে তালিকা পেশ করেছেন মন্ত্রী তাতে দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে এই নতুন শিল্পের বিকাশে। দেশের বড় পাঁচ রাজ্যের মধ্যে আসতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ। স্টার্ট আপে নতুন শিল্পের সংখ্যা ২০২২ দেশে মোট ছিল ২৬ হাজার ৫৯৬, তা ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ৩৪ হাজার ৮৪২টি। এই সংখ্যা মহারাষ্ট্রে একই সময়ে ৪ হাজার ৮১৩ এবং ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয় ৫ হাজার ৮১৬। দ্বিতীয় স্থানে গুজরাট। একই সময়ে ২ হাজার ২৮২ থেকে বেড়ে ৩ হাজার ২৮৫ কোম্পানি হয়েছে। তৃতীয় উত্তর প্রদেশ, ২ হাজার ৫৮৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৪৩১। চতুর্থ দিল্লি, ২ হাজার ৫৮০ থেকে বেড়ে তা হয়েছে ৩ হাজার ২৯৫। পঞ্চম কর্নাটক, ২ হাজার ৫৬৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৩৬টি। ষষ্ঠ তামিলনাড়ু, ১ হাজার ৮১১ থেকে বেড়ে হয়েছে ২হাজার ৮১৬। সপ্তম হরিয়ানা, ১ হাজার ৩৩৪ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৭৪২। অষ্টম কেরালা, ১ হাজার ৭৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২৯৬। এর পরে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের নাম। স্টার্ট আপ নতুন শিল্প সংখ্যা ১ হাজার ২ থেকে বেড়ে মাত্র ১ হাজার ১৭৪ হয়েছে। দেশের বড় রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে কম স্টার্ট আপ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেই। নতুন শিল্প বিনিয়োগ নিয়ে প্রচুর শোরগোল সরকার তুললেও তাতে কোনও সাড়া মেলেনি তা তথ্যে স্পষ্ট।
এদিকে, বড় শিল্প পশ্চিমবঙ্গমুখী না হলেও শিল্পে নানা আর্থিক জালিয়াতিতে যুক্ত শিখণ্ডি সংস্থা বা ভুয়ো কোম্পানির বড় আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ সহ কিছু বড় রাজ্য। ভুয়ো কোম্পানির আশ্রয়স্থল পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্য বড় রাজ্যে রয়েছে মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশে, দিল্লি। সেখানে ভুয়ো কোম্পানির রমরমা সব থেকে বেশি বেড়েছে। এই ভুয়ো কোম্পানিতে কোনও নতুন কর্মসংস্থান হয় না। তবে দুর্নীতির টাকার পাচারের জন্য তা গজিয়ে ওঠে। মন্ত্রীর পেশ করা ভুয়ো কোম্পানির তালিকায় বলা হয়েছে, দেশে ভুয়ো কোম্পানি বহু সংখ্যায় বেড়েছে। যেমন ২০১৯-২০ সালে দেশে মোট ভুয়ো কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৫৮ হাজার ৯৯৫টি। তা ২০২৩-২৪ সালে মোট ভুয়ো কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২লক্ষ ৩৩ হাজার ৫৬৬টি। তা পশ্চিমবঙ্গে তা একই সময়ে ছিল ৬ হাজার ৫৪৭টি। তা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার ৩০৪টি। দিল্লিতে ১০ হাজার ২৮৪ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৫ হাজার ৬৩৭টি। উত্তর প্রদেশে ৫ হাজার ৭৮৯ থেকে বেড়ে ২২ হাজার ৬৪৪টি। মহারাষ্ট্রে তা ৭ হাজার ৬১৯ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৬ হাজার ৬৫৬টি।
দেশের বেহাল অর্থনীতির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে অর্থনৈতিক অগ্রগতি একেবারেই থমকে গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সান্যাল। তিনি তাঁর ‘রিলেটিভ ইকনমিক পারফরমেন্স অব ইন্ডিয়ান স্টেটস: ১৯৬০-৬১ টু ২০২৩-২৪’ গবেষণাপত্রে জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গ ১৯৬০ সালে অর্থনীতিতে যে স্থানে ছিল তার থেকে অনেক পিছিয়ে গেছে। তিনি জানান, ১৯৬০-৬১সালে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ হতো পশ্চিমবঙ্গ থেকে। আজ ২০২৩-২৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে পড়ায় সেই জিডিপিতে হার কমে হয়েছে মাত্র ৫.৬ শতাংশ। ১৯৬০-৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মাথাপিছু আয় ছিল জাতীয় মাথাপিছু আয়ের ১২৭.৫ শতাংশ উপরে। তা ২০২৩-২৪ সালে কমে হয়েছে জাতীয় গড় আয়ের মাত্র ৮৩.৭ শতাংশ। পিছিয়ে পড়া রাজ্য রাজস্থানের থেকেও মাথাপিছু আয় কম হয় এখন পশ্চিমবঙ্গে। তিনি জানাচ্ছেন, ১৯৬০-৬১ সালে মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ এবং তামিলনাড়ু ছিল সবচেয়ে বেশি শিল্প উন্নত রাজ্য। মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু দুই রাজ্য শিল্পে প্রসার ধরে রাখতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গ তা পারেনি। অনেকে মনে করছেন, রাজ্যে গত ১০ বছরে শিল্প পুরো ধসে গিয়েছে বলা যায়। দেশের সার্বিক সঙ্কটে অন্য রাজ্যে অগ্রগতি থমকে গেলেও পশ্চিমবঙ্গে এখন অবনতি এতটাই যে তার দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই।
West Bengal Industry
টাটাদের তাড়ানোর পর শিল্পের রাজ্যত্যাগ বেড়ে
×
Comments :0