প্রবন্ধ
ভাবনা ভাবায় সুকুমার রায়
কৃশানু ভট্টাচার্য্য
মুক্তধারা
" এমন কত জিনিস আছে যা আমরা সর্বদাই দেখে থাকি এবং তাতে কিছু মাত্র আশ্চর্য বোধ করি না। অথচ সেইসব জিনিসই যখন প্রথম লোকে দেখেছিল তখন খুব একটা হইচই পড়ে গেছিল । প্রথম যে বেচারা ছাতা মাথায় দিয়ে ইংল্যান্ডের রাস্তায় বেরিয়েছিল তাকে সবাই মিলে ডিম ছুড়ে এমনই তাড়াহুড়ো করেছিল যে বেচারার প্রাণ নিয়ে টানাটানি।" লিখছিলেন রেলগাড়ির কথা নিয়ে। শুরুটা করলেন এমনি সব মজাদার গল্প নিয়ে তার সঙ্গে রেলগাড়ির কোন সম্পর্ক নেই। যেমন বললেন, আরাম করে নিজের মুখে পাইপ দিয়ে তামাক সেবন করছিলেন সেই দিনকে তার চাকর মনিবের মুখে আগুন লেগেছে মনে করে। এক বালতি জল নিয়ে মাথায় ঢেলে দিয়েছিল। বললেন প্রথম যখন আলু খাওয়া শুরু হল তখন দেশে নানা রকম প্রচার শুরু হয়েছিল যে আলু খেয়ে লোক মরে যেতে পারে। যখন কলকাতায় হাওড়ার পোল তৈরি হয়নি সে সময় নদীতে নৌকার উপর খিলান ভাসিয়ে ফুল তৈরি প্রস্তাব দিয়েছিল এক সাহেব। কে নিয়ে কতই না ঠাট্টা। এরপর এলো রেল গাড়ির গল্প। ঠিক এমন ভাবেই তিনি বলতেন তার মনের কথা। সেখানে এক লহমায় রুমাল হয়ে যেত বিড়াল, কাকেশ্বরের অংক করার অদ্ভুত পদ্ধতি যেখানে দুইয়ে দুইয়ে কখনোই চার হয় না। কারণ তিনি সুকুমার রায়।
কি তার পরিচয়? লেখক? সম্পাদক? মুদ্রণ বিদ্যায় পারদর্শী? সবকিছু মিলিয়ে কিন্তু তিনি। বাবা উপেন্দ্রকিশোর যখন এই বাংলায় শিশুদের জন্য সাহিত্যের পাশাপাশি মুদ্রণ শিল্পকে নতুন মাত্রা দেওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর ঠিক সেই সময়ই তার জন্ম। ১৮ ৮৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯১১ থেকে ১৯১৩ বিলেতে আলোকচিত্র আর মুদ্রণ শিল্পে উচ্চতর শিক্ষার জন্য গুরু প্রসন্ন স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করলেন। এর আগে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি তে অনার্স নিয়ে পাস করেছেন বি এস সি। সেটা কলকাতায়। সে সময় নিরিখে এই উচ্চশিক্ষিত মানুষটি কিন্তু যেকোনো ধরনের সরকারি কাজে নিয়োজিত হতে পারতেন কিন্তু সেদিকে না হেঁটে শিশু সাহিত্য আর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। ইউ এন রায় এন্ড সন্সে বিকাশে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ম্যানচেস্টারে স্কুল অফ টেকনোলজি তে স্টুডিও এবং ল্যাবরেটরি কাজ শিখে দেশে ফেরার পরে এদেশের মুদ্রণ শিল্পের চেহারাটাকে বদলে দেবার জন্য ক্ষণস্থায়ী জীবনটাকে কাজে লাগালেন সুকুমার। আর সেই সঙ্গে চলল লেখালেখি। আবোল তাবোল, খাই খাই, পাগলা দাশু , বহুরূপী, হ য ব র ল একের পর এক অনাবিল সৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য কে সমৃদ্ধ করলেন সুকুমার রায়। লিখলেন বেশ কয়েকটি মজাদার নাটক। সেগুলি অবশ্য তার অনুগামীদের নিয়ে গঠিত ননসেন্স ক্লাবের অভিনয়ের জন্যই তৈরি। অথচ আজো মজার নাটক হিসেবে সুকুমার রায়ের ঝালাপালা, লক্ষণের শক্তিশেল , অবাক জলপান, চলচ্চিত্তচঞ্চরি কিংবা শব্দকল্পদ্রুম কোনটারই জনপ্রিয়তা কম নয়। পারিবারিক শিশু সাহিত্যের পত্রিকা সন্দেশের জন্য এরই পাশাপাশি লিখেছেন জীবনী বিজ্ঞানের গল্প নানা ধরনের বিষয় নিয়ে বিবিধ রচনা। সে তালিকাও কম দীর্ঘ নয়। এখানে যেমন সমুদ্র, কুমির, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, ঈগল , ফড়িং , নিশাচর প্রাণী, বেবুন, গরিলার কথা রয়েছে তেমনি রয়েছে ডেভিড লিভিংস্টোন এর জীবনী। লিখেছেন সক্রেটিস, দানবীর কর্নেগী , আলফ্রেড নোবেল , আর্কিমিডিস , গ্যালিলিও, ডারউইন, পাস্তুর , কলম্বাসের মতো মানুষদের জীবনের গল্প। সহজ সরল ভাবে লেখাটা ছিল তার অনায়াস আয়ত্ত। বাস্তব আর অবাস্তবের বৈপরীত্যমূলক অবস্থান পাশাপাশি রেখেছিলেন সুকুমার রায়।
আবোল তাবোল এর কবিতায় উঠে এলেন সংগীতশিল্পী বিশ্ব লোচন শর্মা কিংবা বিজ্ঞানী চন্ডীদাসের খুড়ো। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এগুলো প্রায় সবই অসম্ভব কিন্তু কবিতায় কল্পবিজ্ঞানের জগতকে উন্মোচন করেছিলেন সুকুমার রায়। বোম্বাগড়ের রাজার কাণ্ডকারখানা এক গভীর রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র । সুকুমার রায়ের কল্পনায় ফুটো স্কোপ যন্ত্র দিয়ে মানুষের মগজ দেখা যেত। মগজে কতটা ভেজাল আর কতটা বুদ্ধি আছে তার হিসেব পাওয়া যেত। মুন্ডুতে ম্যাগনেট ফেলে বাঁশ দিয়ে রিফলেক্ট করে ইট দিয়ে ভেলোসিটি কষে সুকুমার রায় বুঝতে চেয়েছিলেন মাথা ঘোরে কি ঘোরে না। শিশু রা পড়ে হেসেছে। সে শিশু বড় হয়ে ভেবেছে। তিনি ভাবিয়েছেন , ভাবাতে পেরেছেন।
আজ তার জন্মদিন। আজ আমাদের ভাববার দিন।
আজগুবি সব মনের ঘরে,
হিজ বিজ বিজ জটলা করে।
পাগলা দাশুর সহজ কথা,
আবোল তাবোল হেথা হোথা।
আদিম কালের চাদিম হিম,
তোড়ায় বাধা ঘোড়ার ডিম।
আজগুবি সব মনের কোঠায়, ভাবনা ভাবায় সুকুমার রায়।
Comments :0