Com Swadesh Chakrabarty

প্রয়াত কমরেড স্বদেশ চক্রবর্তী

রাজ্য

—হাওড়ার প্রাক্তন মেয়র ও প্রাক্তন সাংসদ প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা কমরেড স্বদেশ চক্রবর্তীর জীবনাবসান হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যা সাতটা দশ মিনিটে সালকিয়ায় শম্ভু হালদার লেনে নিজের বাসভবনেই পার্টির রাজ্য কমিটির প্রাক্তন সদস্য কমরেড স্বদেশ চক্রবর্তী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। 
বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্বদান ছাড়াও সাংসদ, মেয়র, হাওড়া ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ও এইচআরবিসি’র চেয়ারম্যান পদে দায়িত্বপালনের সময়ে তাঁর পরিকল্পিত উন্নয়নের কাজের নিদর্শন এখনও জ্বলজ্বল করছে। পোশাক শিল্পের কারিগরদের উন্নয়নের জন্য গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে যে ১৪ তলা হাব রূপায়ণে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেটাই এখন রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক সদর ‘নবান্ন’ হিসাবে পরিচিত। তাঁর প্রয়াণে রাজ্যের সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ সহ হাওড়া জেলার মানুষ গভীরভাবে শোকাহত।
স্বদেশ চক্রবর্তী সাম্প্রতিক বছরগুলিতে খুবই অসুস্থ ছিলেন, চোখে দেখতে পেতেন না প্রায়। শেষদিকে পারকিনসনস্‌ও দেখা দেওয়ায় শয্যাশায়ী ছিলেন। তাঁর স্ত্রী পুস্প চক্রবর্তী এবং কন্যা সম্পূর্ণা চক্রবর্তী দুজনেই সিপিআই(এম)’র সদস্য, মহিলা আন্দোলনের নেত্রী। কমরেড স্বদেশ চক্রবর্তীর প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা বিমান বসু, পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সহ বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। স্বদেশ চক্রবর্তীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মহম্মদ সেলিম তাঁর বাড়িতে ফোন করে পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানান। সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদকণ্ডলীর সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, পার্টির হাওড়া জেলা কমিটির সম্পাদক দিলীপ ঘোষ সহ পার্টি নেতৃবৃন্দ এদিন রাতেই স্বদেশ চক্রবর্তীর বাড়িতে যান। পরিবারের সঙ্গে আলোচনার পরে তাঁরা জানিয়েছেন, এদিন বাড়িতেই রাখা থাকবে প্রয়াত নেতার মরদেহ। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় মরদেহ নিয়ে আসা হবে সিপিআই(এম)’র হাওড়া জেলা দপ্তরে, সেখানে পার্টি নেতৃবৃন্দ এবং অনুরাগী বহু মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসবেন। তারপরে সালকিয়ায় ত্রিপুরা রায় লেনের পার্টি দপ্তর হয়ে বাঁধাঘাটে নিয়ে যাওয়া হবে শেষকৃত্যের জন্য। 
শোকপ্রকাশ করে শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘আটের দশকের গোড়া থেকে কমরেড স্বদেশ চক্রবর্তীকে চিনতাম, ভাইয়ের মতো স্নেহ পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে, আবার রাজনৈতিক শিক্ষাও দিয়েছেন। অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ স্বদেশ চক্রবর্তী যেভাবে নিবিড় গণসংযোগ রাখতেন, মানুষের প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দায়িত্বপালন করতেন, তা সবার কাছে শিক্ষনীয়।’ দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘আমাদের নেতা ও অভিভাবককে হারালাম। তাঁর মৃত্যুতে হাওড়া জেলার পার্টি ও গণআন্দোলনের যে বড় ক্ষতি হলো তা পূরণ করতে আমাদের যৌথভাবে সচেষ্ট হতে হবে।’ কমরেড স্বদেশ চক্রবর্তীর প্রয়াণে আরসিপিআই নেতা মিহির বাইন সহ বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দও শোক জানিয়েছেন। 
১৯৪৩ সালের ২২ ডিসেম্বর বর্তমান বাংলাদেশের খুলনায় জন্ম স্বদেশ চক্রবর্তীর। বাবা ছিলেন শৈলেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মা তরুলতা চক্রবর্তী। কিন্তু ছাত্রাবস্থাতেই তিনি হাওড়ার সালকিয়ায় চলে আসেন, তাঁদের আদি বাড়ি সেখানকার শম্ভু হালদার লেনেই। ছয়ের দশকের গোড়ায় তিনি কলকাতায় পড়াশোনার সময়েই বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন, সেই সূত্রেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ১৯৬৩ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পরে স্নাতকোত্তরে তিনি প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহপাঠী ছিলেন। নন্দগোপাল ভট্টাচার্য ও রণজিৎ গুহদের হাত ধরে তাঁরা প্রায় একই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতিতে এসেছিলেন, মতাদর্শগত সংগ্রামও করেছেন। চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় স্বদেশ চক্রবর্তী উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হাতে আক্রান্তও হয়েছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের দুর্বার সময়ে তিনি এসপ্ল্যানেড ইস্টে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, আবার বিনা বিচারে গ্রেপ্তার হয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে রাজবন্দি হিসাবেও আটক ছিলেন। 
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে স্বদেশ চক্রবর্তী ব্যাঙ্ক অব বরোদায় চাকরি পেয়েছিলেন। সেই সময় ব্যাঙ্ক কর্মচারী আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং অল বেঙ্গল ব্যাঙ্ক অব বরোদা এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়শনের সহ-সম্পাদক, সহ-সভাপতি এবং তারপর সাত বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 
১৯৬৩ সালে পার্টির সদস্যপদ অর্জন করার পরে ১৯৭১ সালেই তিনি সিপিআই(এম)’র হাওড়া জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং তারপর ১৯৭৯ সালে পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। ২০০৮ সালে কলকাতায় মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলনে তিনি পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসদীয় রাজনীতিতে তিনি স্থানীয় পৌরপ্রশাসন থেকে লোকসভা পর্যন্ত প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি হাওড়া পৌরনিগমের অল্ডারম্যান ছিলেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি হাওড়ার মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও হাওড়া ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। ২০০০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি এইচআরবিসি’র চেয়ারম্যান ছিলেন। গরিব মানুষের জীবনমান উন্নয়নকে লক্ষ্যে রেখে তাঁর পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রচেষ্টার জন্য তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন এবং ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন। সংসদেও বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসাবে জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। হাওড়া শহর ও জেলায় তাঁর বহু কাজ স্থায়ী উন্নয়নের নমুনা রেখে গিয়েছে। হাওড়া শহরে শরৎ সদন, ডুমুরজলা স্টেডিয়াম, শৈলেন মান্না স্টেডিয়াম, পদ্মপুকুর জলপ্রকল্প ইত্যাদি তৈরিতে তাঁর ভূমিকা মুখে মুখে প্রচারিত। সাংসদ হিসাবে তিনি জেলার স্কুলে স্কুলে কম্পিউটার শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সাংসদ তহবিল থেকে সব স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কম্পিউটার বসানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বামফ্রন্ট সরকার দ্বিতীয় হুগলী সেতু বা বিদ্যাসাগর সেতু নির্মাণের জন্য পদক্ষেপ নিলে সেতুর অ্যাপ্রোচ ওয়ের জন্য জমির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। ধুলাগড়ে ফাউন্ড্রি পার্ক তৈরিতে তিনি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। 
হাওড়া শহরে রাস্তায় ওস্তাগরদের দুর্দশা এবং জরিশিল্পীদের দুর্দশা ঘুচিয়ে পরিকল্পিতভাবে পোশাক শিল্পের উন্নয়নের জন্য বিদ্যাসাগর সেতুর পাশেই একটি হাব তৈরি করায় তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা গার্মেন্টস হাব হিসাবে ঘোষিত হয়েছিল। ভবন নির্মাণ হয়ে গেলেও তার উদ্বোধনের আগেই রাজ্যে সরকার পরিবর্তন হয় এবং পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সেটারই মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বদলে নীল-সাদা রঙ করে ‘নবান্ন’ নাম দিয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক কেন্দ্র বানান।
 

Comments :0

Login to leave a comment