EDITORIAL

রুজিহীন পরজীবী অর্থনীতি

সম্পাদকীয় বিভাগ

সপ্তাহ দু’য়েক আগে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি যে বেশ শক্ত সামর্থ্য, দুঃশ্চিন্তার কোনও কারণই নেই তাই বোঝানোর জন্য মুখ্যসচিবকে সঙ্গে নিয়ে নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের অর্থনীতি নিয়ে, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা নিয়ে বিরোধী দল সহ নানা মহল থেকে অভিযোগগুলি নস্যাৎ করার জন্য নিজের মতো করে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করছিলেন। তার কিছুদিন পর মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অমিত মিত্র রাজ্যের অর্থনীতির অতি উজ্জ্বল ছবি এঁকে জানিয়ে দেন জিডিপি’র পরিমাপ অনুযায়ী দেশের মধ্যে ষষ্ঠ স্থান পশ্চিমবঙ্গে। নরেন্দ্র মোদী যেমন নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য ভারত বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতি বলে ঢাক পেটান সেই পথেই দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গকে ষষ্ঠ বৃহত্তম রাজ্য (অর্থনীতির দিক থেকে) বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাইছেন। অতি সম্প্রতি রাজ্যে লগ্নিকারী কয়েকটি সংস্থার প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে অমিত মিত্র বোঝাতে চেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ নাকি বিনিয়োগের জন্য স্বর্গরাজ্য। দান-খয়রাতির অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করে অমিত মিত্র বোঝাতে চেয়েছেন জোগান নির্ভর অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে চাহিদা নির্ভর নীতি। তারফলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি নাকি তর তর করে এগোচ্ছে। অবশ্য এরাজ্যে যে চুরি, দুর্নীতি ও লুঠতরাজের মাধ্যমে শাসকদলের পান্ডাদের যে একটি শক্তিশালী সমান্তরাল অবৈধ ও কালোটাকার অর্থনীতি গড়ে তুলেছেন সে বিষয়ে অবশ্য অমিত মিত্র টু শব্দটিও করেননি। অমিত মিত্র বোঝানোর চেষ্টা করেছেন খেলা, মেলা, উৎসব, পূজায় দেদার সরকারি অনুদান, কোটি টাকা দিয়ে ক্লাব পোষা, নানা ধরনের শ্রী সহ লক্ষ্মী ভাণ্ডার ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারি অর্থ-বিলিয়ে দিলে মানুষের হাতে পয়সা যাবে। সেই পয়সায় তারা বাজার থেকে নানা জিনিস কিনবে। তাতে বাজারে চাহিদা  বাড়বে। তখন সেই চাহিদা মেটানোর জন্য শিল্পপতিরা ল‍‌গ্নি করতে এগিয়ে আসবে। অর্থাৎ ছাত্রদের ফোন, ল্যাপটপ, সাইকেল ইত্যাদি বিলি করলে এসবের কারখানা হবে। সরকারের বিলি করা পণ্য বা অর্থের জন্য ক’টা কারখানা গত ১১ বছরে রাজ্যে গড়ে উঠেছে তার হিসাব অবশ্য অমিত মিত্র দেননি। এটাও ব্যাখ্যা করেননি ঘরে বসে বিনা পরিশ্রমে অর্থ পাওয়া গেলে মানুষের শ্রমদক্ষতা বাড়ে কিনা বা শ্রমের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির উদ্দীপনা তৈরি হয় কি না।
কোভিড বিপর্যয়ের মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে এই ধরনের প্রকল্প সর্বোচ্চ মাত্রায় অবশ্যই জরুরি। তেমনি সমাজের সেই সেই অংশের কাছে সরকারি সাহায্য পৌঁছানো দরকার যাদের রোজগারের কোনও সামর্থ্য নেই। তেমনি সরকারের দায় মানুষকে কাজ দেওয়া। সরকার যদি তাতে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের ভাতা দেওয়া সরকারের দায়। কিন্তু সরকার কাজ দিতে পারবে না, কাজ সৃষ্টির উপযোগী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নেবে না, শুধু বছরের পর বছর মানুষকে অনুদান দিয়ে অনুদানজীবী ভোটার বানিয়ে রাখবে তা মেনে নেওয়া যায় না। চাহিদা নির্ভর অর্থনীতির মানে আর যা-ই হোক অনন্তকাল ধরে মানুষকে দান-খয়রাতি করে যাওয়া নয়। দুর্ভাগ্যের হলেও এটা সত্য পশ্চিমবঙ্গে গত ১১ বছর ধরে সেটাই হচ্ছে। এরাজ্যে এইভাবে টাকা বিলির জন্য মাসে অন্তত দু’বার বাজার থেকে চড়া সুদে ঋণ নেওয়া হয়। এখন তাতেও কুলাচ্ছে না দেখে সরকারের হাতে যেখানে যত জমি আছে তা বিক্রি করে লক্ষ্মী ভাণ্ডারের টাকা জোগাড়ের চেষ্টা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি খরচের টাকা রোজগার করতে পারে না, জমি বেচে সংসার চালাতে হচ্ছে। কাজ না পেয়ে রাজ্যের মানুষ দলে দলে পাড়ি দিচ্ছে ভিন রাজ্যে। সবল অর্থনীতি নিজের ছেলে-মেয়েদের কাজ দিতে পারে না। তাদের রুজির ব্যবস্থা করছে অন্য রাজ্য।

Comments :0

Login to leave a comment