Bhoot Chaturdashi 2023

আমাদের 'ভূত-ভুতুম' ও চোদ্দশাক-চোদ্দ প্রদীপের কিসসা

ছোটদের বিভাগ


সৌরভ দত্ত

'লিপিকা' গ্রন্থের রূপকধর্মী 'কর্তার ভূত' গল্পে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন এক ভূতে পাওয়া সংস্কারগ্রস্থ দেশের কথা-কাহিনি–"কেননা ভবিষ্যৎকে মানলেই তার জন্যে যত ভাবনা, ভূতকে মানলে কোনো ভাবনাই নেই; সকল ভাবনা ভূতের মাথায় চাপে। অথচ তার মাথা নেই, সুতরাং কারো জন্যে মাথাব্যথাও নেই।" ভূত বা ভূত চতুর্দশী নিয়ে পুরাণ-শাস্ত্রে বিভিন্ন ব্যখ্যা রয়েছে।কিন্তু আমাদের শৈশবের জানালা খুললে দেখতে পাই কালিপুজোর আগের দিনটিকে ভূত চতুর্দশী মেনে উৎসবের নামে বিভিন্ন সংস্কার-আচার পালিত হত।সকাল সকাল বাড়িতে চোদ্দশাক জোগাড় করার হিড়িক পড়ে যেত।চোদ্দশাক রাঁধত মা-মাইমারা।তার পর দুপুর গড়াতে না গড়াতেই কলাপেটোকে চারচৌকো করে কেটে তাতে গোবর দিয়ে অলক্ষ্মীর মূর্তি তৈরি করত ছোটমাসি।অলক্ষ্মীর মাথায় জড়ানো হত ছেঁড়াচুল।ঐদিন সন্ধ্যায় ঠাকুরদালানে লক্ষ্মীপুজো সমাপনের পর চলত অলক্ষ্মী বিদায়ের পর্ব।অলক্ষ্মী বিদায়ের সময় কালকাসুন্দার ফুল দিয়ে অলক্ষ্মীর মূর্তিটিকে বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে নিয়ে গিয়ে পুজো করা হত।অলক্ষ্মীকে কুলোর হাওয়া দেওয়া বা আখের টুকরো দিয়ে ঢ্যাম!কুড়!কুড় কুলো বাজানো চলত।পাশের মন্টুখুঁড়োদের বাগানে হত 'বুড়ির কুঁড়ে পোড়ানো'।আমরা ছোটরা সাহগ্রে তা দেখতে যেতাম।প্যাঁকাঠি,খড় সহযোগে সটান লম্বা এই কুশপুত্তলিকা দহনের এক এক জায়গায় এক এক রকম নাম প্রচলিত ছিল–কেউ একে ন্যাড়াপোড়া বা এঁজোপেঁজোও বলত।বাড়ি ফিরে বাড়ির বয়স্কদের সাথে বাড়ির চিলছাদে উঠে চোদ্দপ্রদীপ জ্বালাতাম।চারদিকের চার চিলেকোঠা ঝলমল করত প্রদীপদানে।মাটির প্রদীপের সাথে বাড়ির চতুর্দিকে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে বাতিদান চলত।সেজদিদি বলত–"আজ ঘরের পিছনে খিড়কির দিকে একদম যাবি না ,আজ ওরা আসে… ।" আমরা ভয়ে তটস্থ থাকতাম।ভূত চতুর্দশী জুড়ে পালিত হত এরকম হরেক সংস্কার।পরে যখন বড় হয়েছি সময়ের পাল্টেছে বুঝেছি এগুলো আসলে কিছুই না।
ভূত-পেত্নি-দৈত্য-দানো বলে আসলে কিছু নেই।এগুলো নিয়ে জুড়ে শৈশবে আকর্ষণ থাকলেও এখন এই তিথিটি আর পাঁচটি একটি সাধারণ দিনের মতোই।ভেতো বাঙালির ভাতের পাতে বড়দের ধমক দিয়ে চোদ্দশাক খাওয়ানোর রীতি আর সেরকম নেই বললেই চলে।কারণ জলাভূমি ধ্বংসের ফলে মাঠেঘাটে চোদ্দশাক এখন দুর্লভ।লোকশ্রুতি অনুযায়ী চোদ্দশাক খেলে বা চোদ্দ প্রদীপ জ্বালালে নাকি ভূত-প্রেত ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না।একথারও কোনো বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই।আসলে ভেষজ চোদ্দ প্রকার শাকের মধ্যে দিয়ে আমাদের ঋতু পরিবর্তন জনিত কারণে, শরীর স্বাস্থ্যের উন্নতির কথা বলা হয়েছে বলে মনে হয়।ভূত চতুর্দশী'র সেইসব সংস্কারের ছায়া হেমন্তের মাঠে কাকতাড়ুয়া হয়ে বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে আছে।আসলে আমাদের শিশু মনস্তত্ত্বে বিষয়টি তখন দাগ কাটলেও বিশ্বায়নচালিত যুগে সামান্য রেখাপাত করে না।এই অচলায়তনের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কর্তার ভূতের সংলাপ ধরেই বলি–"তারা বলে, “ভয় করে যে, কর্তা।কর্তা বলেন, “সেইখানেই তো ভূত।"

Comments :0

Login to leave a comment