বই
শ্রেষ্ঠ কবিতা — পুলক হাসান
মীর ইকবাল
মুক্তধারা
রাজনৈতির পাশাপাশি প্রেম তার কবিতায় একটা কেন্দ্রীয় দ্যোতনা তৈরী করে। প্রেম নারী-পুরুষের চিরায়ত টান ও সংবেদনশীল মানবিক প্রেম তার কবিতার বিষয় ।
চিৎকারের বিপরীতে নৈঃশব্দ হাজির থাকে বলেই চিৎকার চিৎকার হয়ে উঠে। হয়ত সবসময় সবকিছু এরকম বাইনারি নয়। এর মাঝখানে আছে অনেক রংধনু। কবিতায় সৃষ্টিকে এইভাবে বাঁধ বেঁধে দেওয়া মুশকিল। কবিতা শেষ বিচারে অসম্পূর্ণ প্রজাপতিরা এটাকে সম্পূর্ণ করে দেয় যেন। তাই যেন জগৎ ও কবিতার ভিতর লেনদেন চলতেই থাকে সদা। আর সেজন্যই হয়ত যেকোনো সৃষ্টি বিষয়ে আমাদের উৎসুক্যের কমতি থাকে না— কারণ তাতে শেষ কথা থাকে না থাকে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতের উপলব্ধি, বোধ বা ইনসাইট।অন্তর্জগতের বয়ানে আগ্রহী পুলক হাসান। অন্তর্জগতের যেমন একটা বহির্জগৎ রহে তেমনি বহির্জগতেরও একটা অন্তর্জগৎ থাকে। ভিতরের যেমন বাহির থাকে অন্যদিকে বাহিরেরও একটা ভিতর থাকে। কারণ ভিতর বা বাহির অথবা অন্তর্জগৎ কিংবা বহির্জগৎ উভয়ই একইসূত্রে গাঁথা। একের অনুপস্থিতেই অপর অর্থ উৎপাদন করতে থাকে। যেমন কবি মাহমুদ দারবিশ বলেন, নির্জনতাই কবির একমাত্র গন্তব্য নয়। চেতন ও অবচেতনের বয়ানই বাস্তবতা। কিন্তু কবিরা যখন চৈতন্যের প্রশ্রয়ে কবিতা রচেন তার ভিতর অবচেতন গরহাজির থাকে। অপরপক্ষে অবচেতনের প্রশ্রয়ে যখন কবি অনুপ্রাণিত হন তখন চৈতন্যের প্রাধান্য লোপ পায়। সকল কবিতার উদাহরণ হতে পারে পুলক হাসানের কবিতা। পুলক সরলতার সাধনা করেন কবিতার প্রকরণ নিয়ে। সরল বাক্য, সহজ শব্দচয়ন, ধ্বনির তেমন মুর্ছনা নাই তার কবিতায়। কবিতারে ছোটখাটো ঘাসফুলের মতো নিরিবিলি একটা চেহারা দিতে পারাই যেন তার লক্ষ্য।
কবিতায় নীরবতার সাধনা করা সত্ত্বেও পুলক হাসান সেই বাস্তবতাকে এড়াতে পারেন নাই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা তার কবিতা অনুসন্ধান করে ফেরে। স্বদেশ ও স্বজনের রক্ত মাড়ায়ে স্বপ্ন বিলাসের কবিতায় পুলক ভাসেন নাই। ফলে খুব সহজেই তার অন্তর্জগতে বহির্জগতের ব্যাপক প্রভাব মেলে তার কবিতায়। বাংলাদেশ এক দুঃখিনী বেহুলার প্রতিমায় হাজির হয় অহরহ তার কবিতায়। দুঃখিনী বেহুলার পাশে পাশে যেন কবি ভাসেন দেবতারদের স্বর্গ পর্যন্ত। বেহুলা বাংলার সমর্থন আদায় করে নেয় দেবতারদের কাছ থেকে। বাংলা পায় পরমের মর্যদা। নারীই ভূমি ও মানুষের ভূমিকায় গিয়ে দাঁড়ায়। লখিন্দর মৃত নয় এইখানে যেন সে ঘুমায়ে আছে একটু পরেই যেন জাগবে। ঘুমের ভিতরই নদীযাত্রা চলে বেহুলার মান্দাসে। বেহুলার ন্যারেটিভ একটু পাল্টায় ফেলেন পুলক তাঁর কবিতায়। বাংলা যেন এক নারী তার পুরুষের অনুসন্ধান করছেন যুগ যুগ ধরে। সে পুরুষের ঘুম ভাঙতেছে না। যেন আজকের বাংলাদেশের স্বপ্ন এর বাইরে না। অবচেতনে আজকের বাংলাদেশ যেন সেই স্বপ্ন পুরুষ হারা এক নারীর রূপক। লখিন্দর কোনো এক ঘুমন্ত জননেতারই রূপক যেন। পুলকের বেহুলা কবিতা পাঠের পর জীবনানন্দের বেহুলার কথা আমাদের মনে আসে। জীবনানন্দের বেহুলা যেখানে চিরকালীন পুলকের বেহুলা অনেক বেশি বাস্তবতা, সমকালীন ও স্বপ্নতাড়িত। বেহুলা কবিতায় এইভাবে জানান দেয় বেহুলার ন্যারেটিভ।বাংলাদেশ ও এর ভূমির মানুষের জীবন ও আকাঙ্খা স্বপ্নই পুলকের কবিতায় বাস্তবতা তৈয়ার করে।
মৃত্যু অপসৃয়মাণ কিছু নয়। ফলে একটি মৃত্যুই মহাকাল। এইখানে চৈতন্যর অবসানই মৃত্যু নয়। মৃত্যু যে দেখে তারই মৃত্যু হয় মূলত। যে মৃত্যুকে বরণ করে সে জীবনকে বিনিময় করে।মৃত্যুবোধ পুলকের কবিতায় আসছে ক্ষণবাদীদের দৃষ্টিতে। যেইখানে জীব ও জড়ের পার্থক্যের নাম জীবন। জড়ের নিয়তি ধারণই জীবনের মৃত্যু।
পুলক হাসানের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশ করেছে আলোঘর প্রকাশনা ।
Comments :0