গল্প
পুজোর গল্প
তুষার বসু
মুক্তধারা
উল্টোডাঙ্গা থেকে সরিৎ যখন শিয়ালদায় এসে বাস থেকে নামল, তখন দশটা বেজে গেছে। যদিও কলকাতায় আজকের দিনে প্রায় সন্ধেই বলা যায়, আজ পঞ্চমী। রাস্তায় ঠাকুর দেখার ভিড়। সরিৎ স্টেশন চত্বরে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো। বন্যার স্রোতের মতো মানুষ স্টেশন থেকে বেরচ্ছে বা স্টেশনে ঢুকছে। কোনো রকমে ভিড়ের মাঝখান দিয়ে একটু রাস্তা করে নিয়ে এগোল সে। যেখানে কদিন ধরে ঢাকিরা বসেছিল, সেখানে প্রায় কেউ-ই নেই। যে দু'চারজন এখনো আছে তারাও একজায়গায় গুটিসুটি হয়ে আছে ভিড়ের চাপে।
সরিৎ গিয়ে দাঁড়াল তাদের কাছে। মানুষগুলো উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। 'কি গো বাবু ঢাক লাগবে?' ওদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করে। 'হ্যাঁ, কত নেবে?' - সরিৎ বলে। 'বাজনা শুনবেননি?'
'নাহ, কতো লাগবে বলো।' -সরিৎ উত্তর দেয়। লোকটা উঠে দাঁড়ায়। ' একটা ঢাক আর কাঁসি মিলে ধরুনগে পনেরো হাজার। ' ' অ্যাতো!' সরিৎ একটু থমকে যায়। -'আমনি কতো দিতে পারবেন?' 'কতো আর, এই হাজার তিনেক।' ইতস্তত করে বলল সরিৎ।লোকটা নির্লিপ্ত মুখে বলল -' থালে একটা টিনের ঢাক কিনে নিয়ে নিঝেরা বাঝানগে। আমাদের রেট ঐ পনেরো। ' অনেক দরাদরি করেও সাড়ে বারো হাজারের কমে রাজি করাতে না পেরে সরিৎ ফিরেই আসছিলো। এবার আবাসনের পুজোয় তাকে ক্যাশিয়ার করা হয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে সরিৎ বলেছিল পুজোর খরচ সে অন্তত পঁচিশ পারসেন্ট কমিয়ে দেবে। গতবার ঢাকিরা ন'হাজার টাকা নিয়েছিল। তাই ঢাকিদের খরচ কমাতে নিজেই এসেছে বায়না করতে। অফিসের মৃণালের কাছে শুনেছিল পঞ্চমীর রাত্রের দিকে গেলে নাকি ঢাকিদের দর কমে যায়। বায়না হয়ে যাবার পর যারা পড়ে থাকে তারা যাহোক কিছু পেলেই বাজিয়ে দেয়।সেই আশাতেইতার আসা। ভেবেছিল তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকায় ঢাকি পাওয়া গেলে খরচটা বেশ কমে যাবে। সেটা হলোনা। এখন কি করা যায় ভাবতে ভাবতে সরিৎ ভিড়টা ঠেলে এগোতে থাকে। পিছন থেকে তার জামায় টান পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে দেখে একজন মানুষ। -'বাবু, ঢাক লাগবে?' প্রশ্ন করে সে। -'হ্যাঁ' উত্তর দেয় সরিৎ। -'এদিকে আসুন।' বলে লোকটা সরিৎকে ভিড়ের বাইরে আসার ইঙ্গিত করে। একটু ফাঁকা মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকটা বলে
-'ঐ সাড়ে তিন হাজার টাকাই দেবেন বাবু, আমি আর আমার ছেলে যাবো। ' এবার তার দিকে ভালো করে তাকায় সরিৎ। কতো আর বয়স হবে, চল্লিশ -পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু শীর্ণ চেহারা তাকে প্রৌঢ় বানিয়ে দিয়েছে। ' পারবে তো? ' জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় সরিৎ। -'হ্যাঁ বাবু। তবে আমনি এখানে দাঁড়ান। আমি ঢাক নিয়ে আসছি।'
গাড়িতে আসার পথে সরিৎ জেনেছে ঢাকির নাম বাদল। সুন্দরবনের দিকে বাড়ি। তিনচারদিন আগে দশ বছরের ছেলেকে নিয়ে শিয়ালদায় এসে উঠেছে। আজও বায়না না হওয়ায় প্রায় মরিয়া হয়ে সাড়ে তিনহাজারেই রাজি হয়ে গেছে ঢাক বাজাতে। আগে জমিতে চাষবাস করতো। আয়লায় জমিতে নোনা জল ঢোকার পরে আজও সে জমি চাষযোগ্য হয়ে ওঠেনি। পুজোর ক'টাদিন ছেলেটা একটু ভালোমন্দ খেতে পাবে ভেবে ছেলেকেও সে এবার সঙ্গে এনেছে।
★ ★ ★
নবমীর আরতি হচ্ছে প্যান্ডেলে। সরিতের চোখ বারবার দশ বছরের ছোট ছেলেটার দিকে। ঢাকে ঠিকমতো হাত পাচ্ছেনা, তবুওবাজিয়ে চলেছে। মন্ডলদার হাতে কাঁসি। সরিৎ দেখতে পায় ছেলেটার চোখদুটো দিয়ে জলের ধারা নেমে এসেছে। এলইডি আলোর ঔজ্জ্বল্যে সে জলধারা যেন মহার্ঘ্য রত্নের মতো ঝলমল করছে। ওর বাবা বাদলকে আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ধুমজ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। কলকাতার মশার কামড় ঐ জীর্ণ শীর্ণ মানুষ্টা সহ্য করতে পারেনি।বিষয়টি নিয়ে সরিৎকে যথেষ্ট কথা শুনতে হয়েছে সকলের কাছে। উদ্যোগ নিয়ে সরিৎই সকালে বাদলকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ব্লাডটেস্ট হলেও এখনো জানা যায়নি ডেঙ্গু না ম্যালেরিয়া।
সরিৎ তো পুজোর খরচ কমানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কাদের জন্য? আবাসনের প্রায় ২৫০ আবাসিকের দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা। অথচ প্রতি বেলায় একশোজনও খেতে আসেনা। হয় বাড়িতে খাবার আনিয়ে খায় অথবা হোটেলে গিয়ে খেয়ে আসে। দেখেছে এই কয়দিনে কতো দামী দামী স্কচ হুইস্কির বোতল ডাস্টবিনে গড়াগড়ি খেয়েছে। এদের জন্যে খরচ কমিয়ে কি লাভ!
দশমীর পুজো তাড়াতাড়িই মিটে গেছে। নিমাই ঠাকুরের ফেরার তাড়া আছে। বাদলের ছেলেটা ঢাক বাজানো শেষ করে কোনের একদিকে একটা চেয়ারে বসে আছে। মুখটা বিষন্ন। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আবাসিকরা নিজেদের মধ্যে গল্প গুজবে ব্যস্ত। মাঝখানে কচিকাঁচাদের দৌড়াদৌড়ি। এই হট্টগোলের থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছেলেটা দুর্গাপ্রতিমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় প্রাণপণে বাবার আরোগ্য কামনা করছে। সরিতের মনে পড়ে সেও এমনই একদিন ঠাকুরের কাছে কাতর প্রার্থনা জানিয়েছিল। বাবার প্রস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ার পর বেশিদিন বাঁচেননি। ঠাকুর তার প্রার্থনা শোনেনি। বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে সরিতের। সরিৎ ছেলেটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল, -'তোর নামটা কি রে?' ছেলেটা মুখ তুলল। চোখে কেমন একটা শূন্য দৃষ্টি। 'তোর নামকি?' আবার জানতে চাইল সরিৎ। - ' ঝিতেন।' অস্ফুটে বললো সে। ' খেয়েছিস কিছু?' ছেলেটা অবাক চোখে তাকাল।
-'আয় আমার সঙ্গে। ' আবার বলল সরিৎ, তারপর জিতেনকে হাত ধরে নিয়ে চলল নিজেদের ফ্ল্যাটে। বেল বাজাতে মা দরজা খুললেন। সরিতের পিছনে জিতেনকে দেখে মার চোখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠলো। ইশারায় মাকে চুপ করতে বলে জিতেনকে ঘরে ডাকল সে। ঘরে ঢুকে জিতেন মেঝেতে বসে পড়ল।
-'ওখানে নয়, এখানে সোফায় বোস।' -'না, না, ঠিক আছে।' বলে জিতেন। ওকে বসিয়ে রেখে মাকে নিয়ে ভিতরের ঘরে গেলো সরিৎ। -'মা, ছেলেটাকে দেখে আমার বড্ড সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। আমিও এমনই ছোটো ছিলাম। তুমি এ ঘরে বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত, আর আমি ঠাকুরের কাছে। ছেলেটাও না কেমন দুর্গাঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়েছিলো। ওকে কিছু খেতে দেবে মা?' মা ঠোঁটদুটো চেপে ধরলেন, আর সরিতের মাথাটা টেনে নিলেন নিজের বুকে।
সরিৎ হাতঘড়িটা একবার দেখল।সাড়ে দশটা বাজে।-' জিতেন, চল আমরা হাসপাতালে যাই। এখন গেলে বাবার সঙ্গে দেখা হবে।' ছেলেটার মুখে একটু আলো ফুটে ওঠে। উঠে দাঁড়ায় সে। দ্বাদশীর দিন সরিতের ট্রেকিংএ যাবার কথা। তার জন্য অফিস থেকে ছুটিও নেওয়া আছে। আজই দুপুরে গিয়ে টিকিটদুটো ক্যানসেল করতে হবে ভাবলো সে। ট্রেকিংএর খরচটা না হয় বাদলের চিকিৎসাতেই দেওয়া যাবে। যে কদিন ও হাসপাতালে থাকবে জিতেনকে নিজেদের ফ্ল্যাটেই রেখে দিতে হবে। আর ছুটিটা থাকায় বাদলের দেখাশোনাও করতে পারবে। মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করে নিলো সরিৎ। রাস্তায় বেরিয়ে এলো জিতেনের হাত ধরে। গেটের উল্টোদিকে টাঙানো হোর্ডিংএ মা দুর্গার মুখটা কেমন প্রসন্ন হাসিতে ভরে গেছে দেখতে পেলো সরিৎ। নিজের অজান্তেই ডানহাতটা কপালে ছোঁয়ালো সে।
Comments :0